ম্যাড্রাসী কারে কয়?

 

ইউটিউবে একটি ভিডিও সর্দি-কাশির ভাইরাসের মত ছড়িয়ে পড়েছে। নাম ‘এন্না দা রাস্কালাস – সাউথ অফ ইন্ডিয়া’। বেশ চনমনে ও মজাদার এই ভিডিও ইতিমধ্যে প্রায় ১৪ লক্ষ বার দেখা হয়েছে মাত্র ২ সপ্তাহে । না দেখে থাকলে দেখে ফেলুন। স্ট্রে ফ্যাক্টরি ও কালচার মেশিন নামের দুই শিল্পীগোষ্ঠী ‘দক্ষিন ভারত’-এর বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র ও পৃথক সংস্কৃতি ও জীবনবৈশিষ্ট-কে তুলে ধরেছেন। ‘মাদ্রাজী’ নাম এক করে দেখা এবং হেয় করার প্রবণতার বিরুধ্যে এই ভিডিও। ‘দেয়ার ইজ নো ম্যাড্রাসী, উই আর অল পারোসি’ ( ম্যাড্রাসী বলে কিছুই নেই, আমরা সকলে প্রতিবেশী) – এই হলো গানের জনপ্রিয় লাইন ও মূলমন্ত্র।

এবেলা স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে ম্যাড্রাসী শব্দটা আমি বাঙ্গালীদের সঙ্গে কথোপকথনে ব্যবহার করে থাকি। এ শব্দটি শুনেই বড় হয়েছি। আসলে, বাংলায়ে ম্যাড্রাসীর সাথে মাদ্রাজী শব্দটিও চালু আছে – রোজকার কথায় এবং সাহিত্যেও, প্রথম হিন্দী ফিলিম হবার অনেক আগে থেকে। নিখিল বাংলাদেশে সাধারণত এই শব্দটি কাউকে নিচু করে দেখাতে ব্যবহার করা হয় বলে মনে হয়নি। আমি গঙ্গা-যমুনার হিন্দুস্তানী এলাকায় বড় হইনি। শুনেছি সেখানে নাকি ম্যাড্রাসী শব্দটি বেশ হেয় করেই ব্যবহার করা হয়। আমার বাংলার ‘মাদ্রাজী ‘ শব্দ, যার মাধ্যমে আমি অন্য বাঙ্গালীর সাথে একটা সাধারণ-ভাবে জানা ধারণাকেই নির্দেশ করি। যদিও এটি মোটামুটি নানান দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠির (যেমন তামিল, তেলুগু, ইত্যাদি) জাতীয়তাগুলিকে বোঝাতে ব্যবহার হয়, সচেতনভাবে তাদের মধ্যেকার তফাত্গুলিকে মোছার লক্ষ্যে ‘মাদ্রাজী’ শব্দের উত্পত্তি নয়। দ্রাবিড় জাতীয়তাগুলির মধ্যের বাস্তব ভিন্নতা নিয়ে আসলে আমাদের মাথাব্যথা ছিল না। বরং এই বাংলাদেশে আমরা যে সব দ্রাবিড় জাতীয়তাগুলির মানুষের সংস্পর্শে এসেছি, তার ভিত্তিতে বানিয়ে নিয়েছি এক ‘মাদ্রাজি’ – যার আকার ও বৈশিষ্ট একান্তই আমাদের নিজস্ব দ্যাখা-শোনার ভিত্তিতে। বাংলাদেশের মনের একটি জায়গায় বাস করে আমাদের এই ধারণার ‘মাদ্রাজী’, কিছুটা বাঙ্গালীর ‘ব্রেজিল-আর্জেন্টিনা’র মত – আগমার্কা আসলের সাথে যার মিল খুজতে গেলে আমাদের নিজেদের গড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াকে এবং সে প্রক্রিয়ার সততাকে অস্বীকার করতে হয়। ঔপনিবেশিক সময়ে নিখিল বাংলাদেশের শহুরে মানুষের অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ফল যে মাদ্রাজী, দক্ষিণের নানান জনগোষ্টির সাথে তার সম্পর্কে দূরের , যদিও পুরো সম্পর্কহীন-ও নয়।

এই উপমহাদেশের দক্ষিন অংশে রয়েছে নানান দ্রাবিড় জাতীয়তাগুলির নিজনিজ মাতৃভূমি। এই এলাকাগুলির একটা বড় অংশ ইংরেজরা ‘ম্যাড্রাস প্রেসিডেন্সি’ নাম দিয়ে এক প্রশাসনের ছত্রতলে নিয়ে আসে। এই সময়েই নানান ভৌগলিক ও জাতিগোষ্টির এলাকা তালগোল পাকিয়ে ‘মাদ্রাজ’ নামক নির্মিত ধারণার উদ্ভব ঘটে। নির্মিত কারণ সাহেবরা এক প্রশাসনের তলায় এনে মানচিত্রে দাগ কেটে দেওয়ার ফলেই ‘মাদ্রাজ’ ব্যাপারটি চালু হয়, ক্রমে হয়ে ওঠে ‘আসল’ কিছুটা। ঠিক এই ঔপনিবেশিক সময়েই, প্রশাসনিক একতা ও মানচিত্রে সাহেবের টানা দাগের ভিত্তিতে আরেকটা ধারণার বাজার আস্তে আস্তে গরম হতে থাকে। সে ধারণাটির নাম ‘ইন্ডিয়া’। যে ধারণাগুলির পেছনে ঠেকা হিসেবে থাকে বন্দুক ও লস্কর, তার নাম হয় জাতিরাষ্ট্র। আর যেগুলির থাকে না, তা থেকে যায় জাতীয়তা হিসেবে।

দেশভাগের পরে রাজ্যগুলির ভাষাভিত্তিক পুনর্গঠন এবং শহরের পুনর্নাম্করণের ফলে ‘মাদ্রাজ’ মোটামুটি অবলুপ্ত হয়েছে। ‘ইন্ডিয়া’ ধারণাটি নানাভাবে বিভক্ত হয়েছে – এক পবিত্র মাতৃভূমি (ভারত নামধারী সংঘ-রাষ্ট্রে), শক্তিশালী ষড়যন্ত্রকারী শত্রু (পাকিস্তানে), দাদাগিরি দেখানো ‘বন্ধু’ (৭১ পরবর্তী পূর্ব্ববঙ্গ অর্থাত গনপ্রজান্তন্ত্রী বাংলাদেশে), এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী (বর্মায়), ইত্যাদি। অনেক উপনিবেশ এলাকাতেই ‘মাদ্রাজ’ বা ‘ইন্ডিয়া’ গোছের ধারণাগুলি গল্পটা একইরকম। একই প্রশাসনের তলায়ে বসবাসকারী নানান জাতীয়তার মানুষ , বিশেষতঃ শহুরে পেশাজীবী ও শ্রমিকেরা, অন্যান্য এলাকার শহরে পৌছয়ে। এই আদানপ্রদানের মাধ্যমে এবং সাহেব বিরুদ্ধতাকে কেন্দ্র করে একটা সাধারণ ঐক্যের ধারণা তৈরী হয় – যা ক্রমে জাতিরাষ্ট্রের হিসেবে বাঁধে। এই ধরনে ধারণা কাল্পনিক বলেই ঐক্য, অখন্ডতা, পতাকা স্যালুট, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পশু, এক সংসদ, এক প্রশাসনিক ক্যাডার (আইএএস, আইপিএস), কেন্দ্রীয় সিলেবাস, শিক্ষা বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি নানা ব্যবস্থার মাধ্যমে এই কল্পনাকে বাস্তবের রং দিতে হয়, মন্ত্রের মত বলে যেতে হয় এই ধারণার পবিত্রতার কথা। আবার একই সাথে ধারালো অস্ত্রে সান দিতে হয় সারাক্ষণ – এই গানের সুরে যারা গলা মেলায় না, তাদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য। এইখানে ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের আশ্চর্য মিল। তা গুমখুন হওয়া বেলুচি-সিন্ধি-মণিপুরী-নাগারা হাড়েহাড়ে জানেন।

‘ইন্ডিয়া’র অন্তর্গত জাতীয়গোষ্ঠির্গুলিকে কেন্দ্র যে এক চোখে দ্যাখে না, সেটা কারো অজানা নয়। কাল্পনিক ‘ইন্ডিয়া’র ”আসল’ আত্মাটি যে বিন্ধ্য পর্বতমালার উত্তরে হিন্দুস্থানী এলাকায়, তা আর বলতে অপেক্ষা রাখে না। বলিউডিয় ‘আম আদমি’ যে পূর্বের বা দক্ষিণের আদমি নন, সেটা পরিষ্কার নিশ্চই পরিষ্কার হয় এশিয়াড বা অলিম্পিকে ‘ইন্ডিয়া’ দলের ‘আসল’ পাগড়ি দেখে – সে মাথা তামিল হোক বা উড়িয়া। পাগড়ি হলো মেনস্ট্রিম। বাকিদের কষ্ট করে বোঝাতে হয় তারা কারা, কি খায়, কি গায়, কি করে, কি পরে, কি বলে, ইত্যাদি। যেমন পুষ্প-প্রদর্শনীতে অজানা গাছের নাম ছোট করে লেখা থাকে , তেমনই আর কি। ‘সাউথ অফ ইন্ডিয়া’ ভিডিওর মূলে রয়েছে ‘আসলি’ ইন্ডিয়ানদের কাছে নিজেদেরকে তুলে ধরার, বুঝিয়ে বলার প্রচেষ্টা। যাতে তাদেরকে একইভাবে স্টিরিওটাইপ না করা হয়। ‘ইন্ডিয়া’র দিল যে দিল্লীতে , একের পর এক নাগা, মিজো , মণিপুরী হত্যা, ধর্ষণ, প্রহার, অপমানের ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় যে সব স্টিরিওটাইপ বাঙ্গালীর ‘মাদ্রাজির’ মত অপেক্ষাকৃত নিষ্পাপ নয়। হিন্দী বচন, গুরগাঁও গমন, দেওয়ালি পালন – এগুলিই ‘ইন্ডিয়া’র আত্মা থেকে দুরে থাকা জনগষ্টিগুলির ‘ইন্ডিয়ান’ হবার সোপান। কিন্তু আমাদের নিজনিজ মাতৃদুগ্ধ-মাতৃভাষা-মাতৃভূমি তো কাল্পনিক নয়। উপমহাদেশের অনেকে ‘ইন্ডিয়ান’ বলতে যাকে কল্পনা করেন, তাদের সাথে অনেক ‘ইন্ডিয়ান’এরই কোন মিল নেই। তারা যদি আজ মাইল গান গায় , ‘দেয়ার ইজ নো ইন্ডিয়ান, উই আর অল পারোসি’ – তারা কি খুব ভুল বলবে? ‘ম্যাড্রাসী’ নামের ধারণাকে যদি বেশি তলিয়ে মারো টান, আরো অনেক পবিত্র কল্পনাও হয় খানখান। তাই, ‘ওপারে যেও না ভাই, ফটিংটিং-এর ভয়’। দিনকাল ভালো না।

2 Comments

Filed under বাংলা, Bengal, Colony, Foundational myths, Hindustan, India, Nation, Pakistan

2 responses to “ম্যাড্রাসী কারে কয়?

  1. Jayanta Bhattacharya

    সুন্দর ঝরঝরে লেখা। এ লেখা “Imagined Communities” বা পার্থ চ্যাটার্জির বিবেচনাকে কিংবা দীপেশ চক্রবর্তী কে উস্কে দেয়। দীনেশ চন্দ্র সেন বা বিবেকানন্দ রোডের হাত ধরে যে বৃহৎ বঙ্গ বা সর্বব্যাপী হিন্দুত্বের সূচনা হয়েছিল এতো তারই প্রসারিত রূপ।প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন চেহারায় নির্মিত হচ্ছে, social psyche কে পুনর্গঠিত করছে। সংলাপ চলুক।

    • Jayanta Bhattacharya

      অটো ফিলিং-এর গুঁতোয় বিবেকানন্দ রোড হয়ে গেল। দুঃখিত!

Leave a comment