রোহিত ভেমুলা ও ঘরের কাছের অন্ধকার

১৬ জানুয়ারী ২০১৬ অর্থাৎ যেদিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি  ঘোষণা করলেন যে ২৫ কোটি টাকা অবধি দরের ‘স্টার্ট-আপ’ কোম্পানি খুলে ব্যবসা শুরু করলে ৩ বছর আয়কর দিতে হবে না, শ্রমিক অধিকার ও ভাতা ঠিকঠাক দেওয়া হচ্ছে কিনা, পরিবেশ দুষিত করা হচ্ছে কিনা, এসবের কোন কিছুরই সরকার ৩ বছর অবধি পর্যবেক্ষণ পর্যবেক্ষণ করবে না, ঠিক তার পরের দিন,  গত রবিবার একজন ছাত্র আত্মহত্যা করেছে। এরম আত্মহত্যা তো কতজন করেই থাকে, কতরকম কি হয় আজকাল – প্রেমঘটিত, অবসাদ, ‘ড্রাগস’। একজন পিএইচডি গবেষণারত ছাত্র আত্মহত্যা করেছে।  সে ক্ষেত্রে আবার যোগ হতে পারে ‘স্ট্রেস’। কিনতু তারপর যদি বলি গ্রামের ছেলে, ইংরেজি মিডিয়াম নয়, দলিত – এমন একজন আমার-আপনার শহরের নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে দু-চোখ জোড়া স্বপ্ন নিয়ে এসে আত্মহত্যা করেছে, তখুনো আমরা একটু হাতরাবো একটু ‘স্ট্রেস’, একটু প্রেম, একটু ‘ড্রাগস’। কিনতু তারপর যদি আরো বলি যে তার বৃত্তির টাকা পাঠাত সে বাড়িতে, তা দিয়ে তার বিধবা মায়ের চলত, তখন হয়ত ‘ড্রাগস’টা বাদ পড়বে। তারও পরে যদি বলি যে সে স্বাভিমান নিয়ে প্রকাশ্যেই বলত যে সে বাবাসাহেব আম্বেদকরের  আদর্শে বিশ্বাসী, সে মৃত্যুদন্ড বিরোধী – তা সে ইয়াকুব মেমনেরই হোক বা কাশ্মীরে কুনান-পোসপোড়ায় কাশ্মীরি নারীদের গণ-ধর্ষণ করা সৈন্যদেরই হোক (পরের মৃত্যুদন্ডটা হয়নি, কোন দন্ডই হয়নি) এবং সে কারণে সে ছিল আমার-আপনার রাষ্ট্রের ঠিকাদারী নেওয়া বিজেপি দলের ছাত্র সংগঠন এবিভিপির চক্ষুশূল, তালে হয়ত বলবেন ব্যাপারটি ‘গোলমেলে’। এবং আরো যদি বলি যে মৃত্যুদন্ডের বিরোধীতা করে মিছিল বার করার জন্য বিজেপির এক সাংসদের অঙ্গুলিহেলনে নতুন  দিল্লীর হুকুমে জো-হুজুরি করা এক কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য্য তাকে ছাত্রাবাস থেকে বহিস্কার করে।  যদি বলি যে তার সেই বৃত্তির টাকা, তার হকের টাকা সে পায়নি বেশ কয়েক মাস? যদি এটাও বলি যে তাকে দলিত বলে সামাজিক বয়কটের মুখোমুখি হতে হয়েছিল নতুন দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের এদেশে চলা হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে? আর কি কি তথ্য লাগবে, সত্যের আর কত পরত ছাড়াতে হবে এইটা বুঝতে যে হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানে পিএইচডি-রত ছাত্র রোহিত ভেমুলার মৃত্যু স্থুলভাবে একটি আত্মহত্যা হলেও একটি অন্য সর্বার্থেই একটি রাজনৈতিক হত্যা?

এই রাজনৈতিক হত্যা কে করেছে, তার একটা সহজ এবং চালক- দায়সারা উত্তর হয়।  সেটা হলো ‘সমাজ’। কিন্নতু  তাকে কি দলিত সমাজ মেরেছে? তাকে কি হিন্দু সমাজ মেরেছে? তাকে কি মোসলমান সমাজ মেরেছে? তাকে কি উচ্চ-বর্ণের হিন্দু সমাজ মেরেছে? বৈষম্যের পৃথিবীতে সমাজ বলে কিছু হয়না, বৈষম্যের টানাপোড়েনে, ঘাত-প্রতিঘাতে লিপ্ত থাকে নানা গোষ্ঠী, নানা সমাজ। বৈষম্যের কারণে এই বিভক্তি আবার এই বিভক্তিই হলো শক্তি। কারণ বহির্শত্রু নিপীড়ক গোষ্ঠীর বিরুধ্যে আত্মশক্তিকে সংগঠিত করার জন্য দরকার আভ্যন্তরীন ঐক্য। আর নিপিরিতের এই নিজে নিজে গোষ্ঠী তৈরী করে নিপীড়ক-কে মোকাবিলা করার প্রয়াসের বিরুধ্যে নানা পাল্টা চেষ্টা চলে, চেষ্টা চলে বৈষম্যগুলিকে বাদ দিয়ে নিপীড়কের ধান্দা অনুযায়ী বিশাল একতার দোকান খোলা, এমন দোকান যার প্রধান মালিক হবে নিপীড়ক, অংশ-মালিক হবে নিপীড়িতের মধ্যে থেকে তৈরী করা দালাল আর লাভের গুড় খাওয়া হবে সকল মানুষের ঐক্যের নাম।  নিপীড়কের ঐক্যের নানা দোকান আছে – সেসব দোকানের নানারকম নাম আছে – যেমন হিন্দুত্ব, ইসলাম, ভারত, ইন্ডিয়া, সমাজ, সুশীল, ইত্যাদি। রোহিত ভেমুলা এইসব স্বপ্ন দেখত এইসব দোকান ভেঙ্গে একদিন খোলা মাঠে মানুষের হাট-বাজার তৈরী হবে।

আমরা বঙ্গবাসী। রোহিত থাকত দূরে। সেই দূর থেকে তার বন্ধুরা জানিয়েছে যে দলিত বলে, তেলুগু মাধ্যমে পড়াশুনো করে উচ্চ-শিক্ষার স্বপ্ন দ্যাখার ধৃষ্টতা দ্যাখানোর জন্যে রোহিতকে এবং তার বন্ধুদের শুনতে হতো টিপ্পনি , হাসাহাসি করা হত মফঃস্বল গুনটুরের গন্ধ গায়ে লেগে থাকা স্বপ্নালু মানুষগুলিকে নিয়ে। আজকে চুনি কোটালের মৃত্যুর প্রায় ২৪ বছর পরে আমরা এমন এক শিক্ষা-

সংস্কৃতি তৈরী করেছি যেখানে মেডিকেল কলেজগুলিতে শহুরে আইসিএসই-সিবিএসইর রমরমা (যদিও পশ্চিমবাংলার ১০% ছাত্রছাত্রীও এইসব বোর্ডে পড়ে না), উত্কর্ষ-কেন্দ্র প্রেসিডেন্সিতে নানা বিষয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষা যাতে বাংলায় না হয়, তার পাঁয়তাড়া করা হয় এই বাংলার মাটিতে থেকে, বসে, খেয়ে মোটা হওয়া একধরনের আরকাঠি  গোষ্ঠীর চক্রান্তে, যাদবপুরের তথাকথিত ‘কুল’ বিভাগগুলি থেকে বাংলায় কথা বলাদের পরিকল্পিত ভাবে হতে হয় হীনমন্যতার স্বীকার, সেখানকার  ইতিহাস বিভাগে বাংলায় স্নাতকোত্তর স্তরের উত্তর লেখার জন্য লাঞ্চিত হতে হয় প্রতিবন্ধী ছাত্র রামতনুকে, অন্য সময়ে ভুলে যাওয়া দিনে এই রকম-ভাবেই বাংলায় লেখার জন্য হেনস্থা হতে হতে আত্মহত্যা করেছিল যাদবপুরের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী পৌলমী সাহা। এই বাংলা বাংলা করলাম এতক্ষণ কারণ বৈষম্যের জন্য  বাংলা একটা উছিলা মাত্র। বাংলা মানে শহর কম মফঃস্বল বেশি গ্রাম আরো বেশি, বাংলা মানে বড়লোক কম গরীব বেশি, বাংলা মানে হাতখরচা কম টিউশনি বেশি, বাংলা মানে গাড়ি কম সাইকেল বেশি – অর্থাৎ বাংলা মানে সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ যাকে জোর করে হারিয়ে দেবার চক্রান্ত চলছে আমাদের এই বাংলাদেশে। প্রেসিডেন্সি যত বাংলা-বিরোধী শহুরে-ইংরেজদের আখড়ায় পরিণত হবে, ততবেশী অসবর্ণ  অধ্যাপক  মহিতোষ মন্ডল লাঞ্ছিত হবেন এই-সকল ‘সুপার-কুল’ পোস্টমডার্ন আখড়ায়। মেডিকেল কলেজগুলি তত বেশি করে গুরগাঁও, নয়ডা ও ক্যালিফোর্নিয়ার ডাক্তার তৈরীর কারখানা হবে। বাংলার গণ-মানুষকে, অন্তজ জনতাকে  জোর করিয়ে হারিয়ে দেবার এই চক্রান্ত বন্ধ হওয়া দরকার। দরকার জনসংখ্যার অনুপাতে সর্বস্তরে সংরক্ষণ। দরকার বিরাট একতার বুটিক দোকান ভেঙ্গে হাট-বাজারের দাপাদাপি। রোহিত ভেমুলার  সুইসাইড নোটটি ইন্টারনেট-এ পাবেন। সেটিকে পড়ুন। বামুন-কায়েত বিপ্লবী আর রেডিকেল-দের অপরাধ-বিলাসের জন্য চে গেভারার মৃত্যু অবধি যেতে হবে না। রোহিত ভেমুলার মৃত্যু আমাদের অন্তরের অন্ধকারগুলিকে  প্রকাশ্যে আনতে সাহায্য করুক।                                        

6 Comments

Filed under Acedemia, বাংলা, Bengal, Caste, Community, Elite, Our underbellies, Scars, Science, Under the skin, Urbanity

6 responses to “রোহিত ভেমুলা ও ঘরের কাছের অন্ধকার

  1. sushanta40

    সুন্দর এবং সঠিক লেখা!

  2. নক্ষত্র পতন। বেদনা জানাবার ভাষা নেই।

  3. দেশ তার সন্তান হারাল। আমিও

  4. দেশ নক্ষত্র হারাল। আমিও সন্তানের পিতা। ক্রুদ্ধ প্রতিবাদ

  5. অসম্ভব একটা বিরক্তি……যাদের হাজার বছর আমরা বই থেকে দূরে রেখেছি … যারা বাবা-মা নাম সই ছাড়া কিছুই জানে না …যে মাঠে থেকে সোজা কলেজ যেতে হয়……যাদের ক্লাসে আলাদা কারা হয় …… এই অসম সামাজিক দৌড়ে সম-মেধার কথাটা কেমন যেন লাগে

  6. কলরব নেই ? সবাই কি on-site এ

Leave a comment