Category Archives: বাংলা

আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে

“তুমি কে, আমি কে, বাঙালি, বাঙালি!” ( মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব্ববর্তী সময়ে গড়ে ওঠা প্রবাদপ্রতিম স্লোগান)

কয় বছর আগে ঢাকার কবি-প্রাবন্ধিক ফারুক ওয়াসিফ কটা কথা বলেছিলো, যা আজকে সৈয়দ সামসুল হককে নিয়ে লিখতে গিয়ে প্রথমেই মনে পড়ছে। ফারুক লিখছে, “এদেশি যারা ইংরেজি লেখা পড়েন, তারা কি বাংলা পড়েন না? অনেকেই পড়েন। উচ্চশ্রেণীর এবাদুর রহমানও বাংলাতেই লিখে থাকেন উচ্চশ্রেণীর জীবন নিয়েই; কিন্তু তাৎপর্যে তা দেশোন্মচনই করে তো! সুতরাং এর মধ্যে শ্রেণীঢং থাকলেও নিছক শ্রেণীর ডাঁট না পুরোটা। এটা হলো কালচার। এই কালচারালাজিম মনে করে, যা কিছু ন্যাটিভ তা নিম্নমানের। ন্যাটিভদের ভাষা ভঙ্গি উপমা ভাব ও কল্পনা এদের টানে না। না টানুক, কিন্তু তাদের নিজেদের মধ্যে টানটা কীসের? লাইফস্টাইলের প্যাটার্ন ছাড়া সেখানেও তো তেমন ঐক্য দেখি না। সুতরাং একে বাংলা বনাম ইংরেজির বিবাদ না ভেবে দেশি ও বিদেশি লাইফস্টাইলের মন কষাকষি ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না। এই ‘দেশ’ প্রবাসী লেখকের মনের মধ্যে চিরকাল অটুট থাকতে পারে, আবার ভৌগোলিকভাবে দেশে বাস করা লেখকের মনের মধ্যেও থাকতে পারে প্রবাসের প্রতি বিরহবেদনা। দেশেও কেউ বিদেশি, বিদেশেও কেউ দেশি থেকে যেতে পারেন যদি, তাহলে পার্থক্যটা অভিপ্রায়ের, সংস্কৃতির, চেতনার, কল্পনার, দায়বোধের এবং দিনের শেষে রাজনীতির।”

ফারুকের শেষের কথাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যে পার্থ্যকতা দিনের শেষে রাজনীতির। আজকে পশ্চিম বাংলার প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে, যখন হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের আগ্রাসনে লুঠ হয়ে যাচ্ছে ইতিহাস, আত্মপরিচিতি, স্বপ্ন, চেতনা আর এই ব-দ্বীপের হাজার বছরের অর্জনে পবিত্র যা কিছু আছে, এই জোর করে ভুলিয়ে দেওয়া সময়তেই আমাদের দরকার সৈয়দ সামসুল হককে, যার শব্দকে, তার শব্দ যে স্বচেতনা থেকে স্ফূরিত হয়, দরকার সেই স্বচেতনা, কারণ স্বচেতনা দরকার এই বিশ্বে নিজেদের খুঁজে পাওয়ার জন্য, দরকার ভুলিয়ে দেবার মাঝে নিজেদের খুঁজে পাবার জন্য, দরকার বানোয়াট কল্পনার মাঝে বাস্তবের নিরিখে নিজেদের গতকালের চেতনায় নিজেদের আজ-কাল-পরশু ঠিক করা, আজ-কাল-পরশুর রাজনীতি ঠিক করা। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে নিজেদের খুঁজে পাওয়া জরুরি। বিশ্ব নিখিলে আমাদের আকাশের তলায় একটা স্থান আছে, নিজেদের মাটির উপরে। দূরের খুঁটিকে সেলাম না করে নিজের মাটিতে খুঁটি পুঁতে তার নিরিখে উত্তর-দক্ষিণ নির্ণয় করা, বিশ্বকে চেনা এবং ফলতঃ নিজেদের চেনা।

এই বিশ্ব মানে উপর থেকে দেখা পৃথিবী নয়, বরং নিজেদের স্থানাঙ্ক থেকে যা দেখা যায়, যা বোঝা যায়, এই দেখা ও বোঝার আলোকে নিজেদের বুঝে নেওয়া। কেন্দ্রে রয়েছে আমাদের মাটি। সে প্রসঙ্গে ফারুক আবার বলেছে, “সালমান রুশদীর পুঁজিপাট্টা সবই উপমহাদেশীয়। পামুক কি মোরাকামি এত বিক্রি হয়; কারণ তাদের দেশজতা। অরূন্ধতি রায় কেরালার জীবন নিয়েই নাম কাড়েন। কেননা, বিশ্ব উপন্যাসের মহাফেজখানায় সেটুকুই তো অনাস্বাদিত! দেশবোধকে তাই বোধহয় অস্বীকার করা যায় না। জিয়া হায়দার রহমানের উপন্যাস পড়ছি, তাঁকে দেশহীন মনে হচ্ছে না, যদিও পটভূমি অন্য মহাদেশ। আপনি যদি কোনো সংস্কৃতি ও জীবনকে না বোঝেন, তাহলে আপনি কোথাকার কেউই হতে পারবেন না। লোকাল না হলে গ্লোবালের মজা বুঝবেন না। ব্যক্তির চেতনায় দেশের কল্পনা, দেহ–ভূগোলের স্পর্শ, ইতিহাসের বনলতার চোখে তাকানো ছাড়া বড় কাজ হয় বলে বিশ্বাস করি না। উদাহরণ নাই।”

আমি কবি নই, কবিতার খুব পাঠকও নই, কিন্তু এই বাংলায় বাংলা ও বাঙালির রাজনীতি ও নিজেকে বুঝে নেওয়ার যে আলোক বর্তিকাগুলি, তার মধ্যে আমি অবশ্যই ধারণ করি সৈয়দ শামসুল হককে।

“আমি জন্মেছি বাংলায়
আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে ?
আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।
এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে
এসেছি বাঙালি জোড়বাংলার মন্দির বেদি থেকে।
এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে
এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।
আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে”

সৈয়দ শামসুল হকের শব্দগুলি আমাদের সুযোগ করে দেয় ভাবতে – আমরা মানে কারা, কেন আমার রাষ্ট্র আমার করের টাকায় অন্যের ভাষা প্রচার করে কিনতু আমারটা করেনা। আমাদের ভেবে দেখতে হবে যে আমাদের নিজের নিপীড়িত মাতা থাকতে বিমাতাকে পূজা করতেশেখায় যে রাষ্ট্র, সে রাষ্ট্র কার আর সে রাষ্ট্র কার নয়। আমরা পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালী – বাংলার দেশের (বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নয়) ভাঙ্গা পশ্চিম ভাগ। এই ভাষা আমাদেরও প্রাণের ভাষা, বেঁচে থাকার অবলম্বন, ভালবাসার মাধ্যম, পূর্বসুরীর স্মৃতি, উত্তরসুরীর উত্তরাধিকার, ব্রতের ভাষা- ধর্মের ভাষা-রাজনীতির ভাষা- ঘাম ঝড়ানো কর্মের ভাষা – প্রেমের ভাষা- ফোপানোর ভাষা – খোঁটার ভাষা – অপরাধের ভাষা- দাঙ্গার ভাষা- যৌনতার ভাষা -না বলা কথার ভাষা – ভুলে যাওয়া দিনের ভাষা – আগামীকালের ভাষা- শপথের ভাষা -মুক্তির ভাষা। আমরা বাঙ্গালী।

এই পশ্চিম বাংলার আমরা, আমরা তো বানের জলে ভেসে আসিনি। আমাদের একটা অতীত আছে। সৈয়দ শামসুল হক দেন সে অতিচেতনা, দীর্ঘ, বহুত্ববাদী সে অতিচেতনা, বাঙালি সে অতীত চেতনা। এবং আজ যখন আমরা এই বাংলার স্বাধিকার তথা সম্মানের এক কঠিন লড়াই-এর দিকে অগ্রসর হচ্ছি, তখন পাথেয় থাকুন সৈয়দ শামসুল হক। কারণ উনি আমার জাতির। উনি ওনার কবিতায় আমার কথা বলেছেন। আমি ওনার লাইনে আমার কথা শুনেছি। কান পেতে শুনেছি, সে লাইনের মধ্যে রাজনৈতিক নির্দেশ। মননজগতে আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতীক কবি সৈয়দ শামসুল হক চলে গেলেন। উনি অক্ষয় স্বর্গ লাভ করুন। আমাদের জন্য রেখে গেলেন অনেক নির্মাণের গুরুদায়িত্ব। অনেক পথ চলা বাকি। অনেক প্রাচীর ভাঙা বাকি। অনেক প্রাচীর গড়া বাকি। আমরা চেষ্টা করবো কবি।

1 Comment

Filed under বাংলা, Bengal, Memory, Uncategorized

ভারতের নতুন টাকার নোট ও হিন্দী-দিল্লী আধিপত্যবাদ

ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক নতুন ৫০০ ও ২০০০ টাকার নোট চালু পরপরেই এই নতুন নোটের নানা বৈশিষ্টকে বেআইনি বলে অভিযোগ করে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে মাদ্রাজ হাইকোর্টে। বিচারপতি সে মামলা গ্রহণ করেছেন এবং প্রাথমিক শুনানিতে সরকারপক্ষের এই বক্তব্য যে দেবনাগরীতে সংখ্যা আসলে সংখ্যা নয়, নকশা মাত্র, এ হেন সাফাইতে  সন্তুষ্ট হননি। সরকারপক্ষ আরো সময় চেয়েছে। আগের ৫০০-১০০০ টাকার নোট বাতিলের ফলে যে রাষ্ট্রব্যাপী ব্যাপক আর্থিক অস্থিতি তৈরী হয়েছে, এই নতুন নোট আস্তে আস্তে তা সামলাবে। অথচ এই নতুন নোটের ডিজাইনের মধ্যে নিহিত রয়েছে এমন কয়েকটি জিনিস, তা এই ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন সংঘরাষ্ট্রের ভাষিক  জাতিসমূহের মধ্যে যে মৌলিক বোঝাপড়া, তাকে পদদলিত করে। এই নতুন নোটে অগ্রাধিকার পেয়েছে ৩টি জিনিস – হিন্দি, দিল্লি ও মোদী।

নতুন নোটগুলিতে সংখ্যা বড় করে ছাপা হয়েছে হিন্দির সর্বাধিক প্রচলিত ও প্রচারিত লিপি দেবনাগরিতে। আগের নোট সংখ্যা দেবনাগরীতে ছিল না। নতুন দিল্লীর কেন্দ্রীয় সরকার কি মনে করে যে হিন্দিভাষীরই একমাত্র মাতৃভাষায় নোটের সংখ্যা পড়ার অধিকার আছে, আর অহিন্দীভাষীদের নেই? টাকার নোটে কোন লিপিতে সংখ্যা থাকবে, তা নির্ধারণ করে সংবিধান ও রাষ্ট্রপতির নির্দেশাবলী। সংবিধানের ৩৪৩ নং ধারায় পরিষ্কার ভাবে বলা আছে যে ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন সংঘরাষ্ট্রের যে কোন সরকারী (অফিসিয়াল ) কাজে ব্যবহার করতে হবে আন্তর্জাতিক সংখ্যালিপি। যার মানে হলো “ইংরেজি”তে আরবি-হিন্দু সংখ্যা। অর্থাৎ 1,2,3 ইত্যাদি। এতদিন তাই  হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক লিপি ছাড়াও নোটের ব্যাপারে দেবনাগরী লিপিতে সংখ্যা ছাপা যাবে, এই মর্মে কোন রাষ্ট্রপতির নির্দেশিকা বা সাংবিধানিক বিধান নেই। ১৯৬০-এর রাষ্ট্রপতির নির্দেশিকায় বলা আছে যে দেবনাগরী লিপির সংখ্যা শুধু সেই কেন্দ্রীয় সরকারী প্রকাশনার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে, যে ক্ষেত্রে জনতার যে অংশের জন্য এই প্রকাশনা, তার জন্য এটি জরুরি। প্রথমতঃ, টাকার নোট কোন কেন্দ্রীয় সরকারী “প্রকাশনা” নয়। ফলে এই নির্দেশিকা এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আর দ্বিতীয়তঃ, টাকার নোটে ছাপা তথ্য কি শুধু হিন্দিভাষীদের জন্য? বাকিরা কি বানের জলে ভেসে এসছে? এই সকল ধারণার একটা মিথ্যা উত্তর মজুত থাকে।  সেটা হলো হিন্দী হলো ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন সংঘরাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা। এই দাবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা হওয়া সত্ত্বেও সরকারি ও বেসরকারি কায়েমী স্বার্থান্বেষী চক্র গত ৭০ বছর ধরে এই মিথ্যা প্রচার করে চলেছেন।  ভারতের সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা ধারণাটিরই কোন স্থান নেই। ভারতের কোন রাষ্ট্রভাষা নেই। গুজরাট হাইকোর্ট তার বিখ্যাত রায়তে স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে অহিন্দী রাজ্যে, হিন্দী বিদেশী ভাষার সমতুল্য।

ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন নামক সংঘরাষ্ট্রে অহিন্দীভাষী জাতিসমূহ যে চুক্তির দ্বারা হিন্দীভাষী জাতির সাথে আবদ্ধ, তার নাম দিল্লীতে ক্ষমতাধারী পার্টির হিন্দীকরণের ম্যানিফেস্টো নয়। তার নাম সংবিধান। টাকার নোটে এই সংবিধানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো প্রকারান্তরে ইন্ডিয়ান উনিয়নের ঐক্যের উপর আঘাত হানা। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে যে রাজনৈতিক আদর্শ মানুষে মানুষে ভাষার প্রশ্নে বৈষম্য ঘটায় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিককে ভাষার প্রশ্নে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করে, তা কোন বহুভাষী রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণময় নয়। এ ব্যাপারে হাতের কাছে ১৯৭১-পূর্ব্ববর্তী পাকিস্তান এক জ্বলন্ত উদাহরণ।

যদি শাসকেরা চাইতেন যে ইংরেজি ছাড়াও মানুষের অন্যান্য ভাষায় সংখ্যাগুলি পঠিত হওয়া জরুরি, তার দুটি সহজ উপায় ছিল। এক, টাকার নোট যেহেতু প্রচার বা স্তুতির স্থান নয়, বরং একটি নিত্য ব্যবহারিক বস্তু, তাই টাকার বিনিময় কার্য্যের সাথে অপ্রাসঙ্গিক অন্যান্য ছবি ও নকশা তুলে নিয়ে অনেকগুলি ভাষার লিপিতে একই সাইজে সংখ্যা দেওয়া যেতো। দুই, ইউরো মডেল নেওয়া যেতো।  সে ক্ষেত্রে, ভাষিক জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত নগদের সমানুপাতিক হারে নানা সিরিজের নোট ছাপা যায়, যেখানে ইংরেজি সংখ্যার সাথে কিছু শতাংশ নোটে সংখ্যা থাকবে বাংলায়, কিছু শতাংশে দেবনাগরীতে, কিছু শতাংশ তামিলে, ইত্যাদি। দুর্ভাগ্যের কথা এই যে যখন এই উপমহাদেশ ফিরিঙ্গী শাসনাধীন ছিল, তখন কিন্তু এই এলাকায় চালু টাকার নোটে ৯টি লিপিতে সংখ্যা (ইংরেজি সমেত) একই সাইজে দেওয়া থাকতো। ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দের ১০ টাকার নোট দ্রষ্টব্য। একই সাথে একই সাইজে থাকতো নানা ভাষায় টাকার অঙ্কটি অক্ষরে লেখা – যথা বাংলায় দশ টাকা। বহু ভাষাকে সমমর্যাদা দেবার ব্যাপারটির ইতি ঘটে ১৯৪৭-এ ইন্ডিয়া রাষ্ট্র গঠিত হবার সাথে।  তবে থেকে হিন্দি তথা দেবনাগরী পরিণত হয় তথ্য দেবার জন্য বড় আকারে। অন্যান্য ভাষা পর্যবসিত হয় পিছনদিকের এক ছোট প্যানেলে গাদাগাদি করে ক্ষুদ্র আকারে, বৈচিত্রের পরাকাষ্ঠা হিসেবে। ১৯৪৭এর পর থেকেই ক্রমাগত টাকার নোটে হিন্দীর মোট এলাকার তুলনায় ইংরেজি ব্যতীত অহিন্দী ভাষাসমূহের মোট ছাপা এলাকা কমেছে বিরাটভাবে। ঔপনিবেশিক শাসনের তুলনায় টাকার নোটের মাধ্যমে বিভিন্ন ভাষিক জাতীয়তাগুলির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য যে ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর পরবর্তী ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন রাষ্ট্রে লঙ্ঘিত হয়েছে, তা শুধু লজ্জার বিষয় নয়, চিন্তারও বিষয়। অহিন্দী ভাষাগুলির এই প্রান্তিকায়ন আকস্মিক নয়, প্রকট ভাবে পরিকল্পিত কেন্দ্রীকরণ-মূলক রাষ্ট্রনীতিরই অঙ্গ। ১০% তামিল আর ৭৫% চৈনিক জনগোষ্ঠীর সিঙ্গাপুর তাদের টাকার নোট তামিল, চীনা ও ইংরেজিতে একই সাইজের অক্ষরে নোটের অঙ্ক ছাপে। আসলে সমতা হোক বা বৈষম্য, ইচ্ছা ও নীতিটা আসল। নোট তারই বহিঃপ্রকাশ।

নতুন নোটে রয়েছে দেবনাগরী “র” অক্ষর সম্বলিত নতুন টাকার আইকন। এই আইকন বাছাইকালে কোন জনমত যাচাই হয়নি। আমার ভাষা বাংলা তথা অসমীয়াতে টাকা শব্দ যে অক্ষর দিয়ে শুরু, তা হলো “ট”, হিন্দীর রুপিয়ার “র” নয় । যদি আজ “র” এর জায়গায় সকল নোটে “ট” সম্বলিত আইকন ব্যবহার হতো, তাহলে হিন্দিভাষীরা কি মনে করতেন? তারা ছেড়ে দিতেন? আসলে হিন্দী আধিপত্যবাদের এই রাষ্ট্রে এই “ট” আইকন কল্পনা করাও শক্ত। পরিকল্পিত ভাবে অহিন্দীদেড় প্রান্তিক করে দেবার যে নানা প্রকল্প চালু হয়েছে, তা এখন টাকার নোটেও ঢুকে গেলো আরো জোরালো ভাবে।

কেউ বলতে পারেন, তাহলে ইংরেজিই বা এতো পবিত্র কেন? হিন্দী হলেই যত অসুবিধে? হিন্দী তো অন্ততঃ বিদেশী নয়। এ প্রসঙ্গে ফের মনে করাতে চাই, যে হ্যাঁ ইংরেজি বিদেশী ভাষা, এবং অহিন্দী মানুষের কাছে হিন্দীও বিদেশী ভাষাই। পূর্বোল্লোখিত গুজরাট হাই কোর্টের রায় সেটা পরিষ্কার করে দেয়। আমরা যেন দেশ ও রাষ্ট্র, এই ভিন্ন দুটি ধারণাকে এক না করে ফেলি। অবশ্যই, সকল ভাষার সমান অধিকারই আদর্শ উপায়।  তার ব্যতিরেকে কেন ইংরেজি, সে নিয়ে প্রবাদপ্রতিম গণনেতা তামিল নাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী আন্নাদুরাই-এর মন্তব্য স্মর্তব্য। তিনি বলেছিলেন, ইন্ডিয়ান উনিয়নের মতো একটি বহুভাষিক সংঘরাষ্ট্রে প্রতিটি ভাষিক জাতীয়তাকে সুবিধা ও অসুবিধা সমান ভাবে ভাগ করে নিতে হবে। তবেই ঐক্য সাধিত হবে। ইংরেজি হলো এই ভাষিক জাতীয়তাগুলি থেকে সমদূরত্বে। এটাই ইংরেজির সুবিধে।  আরেকটি সত্য হলো যে ভারত নামক রাষ্ট্র কল্পিত হয়েছিল ইংরেজিতে – নানা জায়গার উচ্চবর্গের মানুষের মূলতঃ ইংরেজিতে ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে। আজও তা সত্য। এটা অবশ্যই ভারত কল্পনায় উচ্চবর্গের বিশেষ স্বার্থ ও প্রাধান্যকেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়, কিন্তু তা আজকেও সত্য এবং বাস্তব।  ইংরেজি না থাকলে নানা ভাষী শাসক গোষ্ঠীর কোন মেলবন্ধন নেই।

এই নোটে রয়েছে আরো নানা সমস্যা। সংবিধানের অষ্টম তফসিলে গত কয়েক বছরে অন্তর্ভুক্ত বেশ কিছু ভাষা, যেগুলির নিজস্ব লিপি আছে, যেমন মনিপুরের মেইটেইলোন, সাঁওতালি (অলচিকি যার লিপি), সেগুলি নোটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ২০ হাজারেরও কম মানুষের ভাষা সংস্কৃত রয়েছে নোটে কিন্তু ৭০ লক্ষাধিক মানুষের মাতৃভাষা সাঁওতালি নেই, এ কেমন পরিহাস?

অথচ নতুন করে যখন নোট ছাপা হলো, সেই সুযোগ তো ছিল। ফের, প্রশ্নটা সদিচ্ছার ও সমতার, যে সমতার আদর্শকে গলা টিপে মারে ক্ষমতা। ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন সংঘরাষ্ট্রের ভাষিক বৈচিত্রকে নতুন দিল্লী একটি নিরাপত্তা ও ঐক্যের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখে। এই ভাষ্যে, হিন্দি ছাড়া সবকিছুই গোলমালের, অনৈক্যের প্রতীক, আর হিন্দী হলো ঐক্যের প্রতীক। এই প্রায় সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যকামী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা যায় যখন সরকারি ভাষার প্রচার ও প্রসার তথা অন্যান্য ভাষার স্বীকৃতি দেবার বিষয়টি দেখাশুনো করে কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রকের অধীন একটি দপ্তর। নতুন দিল্লি নতুন নিয়ম চালু করেছে যে নিজস্ব লিপিহীন নতুন ভাষাগুলিকে সরকারি পঞ্জীকরণ ও স্বীকৃতি প্রাপ্তির জন্য সেই ভাষা লেখার ক্ষেত্রে দেবনাগরী লিপি আবশ্যিক ভাবে মেনে নিতে হবে।  এখানে সেই ভাষার মানুষ তথা বিদ্দ্বদজনদেড় মতামত গুরুত্বহীন। এই ব্যবস্থার এক বলি হলো বোড়ো ভাষা, যেটির আবাদভূমি কোন হিন্দিভাষী এলাকার সংলগ্ন নয়। বোড়ো  লেখার ক্ষেত্রে দেবনাগরী বাধ্যতামূলক করা হয়েছে নতুন দিল্লীর আদেশে।  এর আগে মোহনদাস গান্ধীর ছবি দিয়ে টাকার নোটের সার্বিক গ্রহণযোগ্যতার রাজনীতিকরণ করা শুরু হয়েছিল। টাকায় এইবার বিজেপি সরকারের “স্বচ্ছ ভারত” প্রকল্পের বিজ্ঞাপন হিন্দিতে ছেপে টাকার নোটকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার প্রক্রিয়াকে অন্য স্তরে নিয়ে গেলো। এর ফলে এবার থেকে টাকার নোট হয়ে উঠবে নিজ প্রবর্তিত সরকারি প্রকল্প বিজ্ঞাপনের এক নতুন ক্যানভাস। একটু একটু করে গণতন্ত্রের মৌলিক নিরপেক্ষতার কাঠামোটি ধ্বংস প্রাপ্ত হচ্ছে।

পুরানো নোটগুলিতে স্থান-ভিত্তিক রাজনৈতিক সিম্বল জায়গা পায়নি ৫০ টাকার নোট সংসদ ভবন ছাড়া। এই সংসদ ভবন সকল নাগরিকের প্রতীক।  অথচ আমরা দেখছি যে নতুন নকশার ৫০০ টাকার নোটে বিরাজ করছে লাল কেল্লার ছবি। এই লাল কেল্লার স্মৃতি ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন সংঘরাষ্ট্রের সকল জাতির কাছে সুখকর নয়। লাল কেল্লা ছিল দিল্লী-কেন্দ্রিক মোঘল সাম্রাজ্যের সদর দফতর। ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন সংঘরাষ্ট্র মোঘল সাম্রাজ্যের উত্তরাধীকারী কোন রাষ্ট্র নয়।  এটি ১৯৪৭-এ সৃষ্ট। দিল্লী-কেন্দ্রিক যে সাম্রাজ্য বাঙালি, অহমিয়া, ওড়িয়া ইত্যাদি নানা স্বাধীন এলাকা দখল করেছিল, লাল কেল্লা সেই স্বাধীনতা হরণের প্রতীক। মূলতঃ হিন্দী-উর্দু ভাষী লোক-লস্কর এই দখলকৃত এলাকায় বসিয়ে তারা এই দেশগুলিকে শাসন করতো। সেই কাটা ঘায়ে লাল কেল্লার নুনের ছিটে দিয়ে আজকের নতুন দিল্লীর সরকার কি প্রমাণ করতে চায়?

৫০০-১০০০ টাকার নোট বাতিলের ঘোষণাটি যখন নরেন্দ্র মোদী দিলেন হিন্দি ও ইংরেজি, ইংরেজির সময়ে পর্দায় ফুটে উঠলো হিন্দি অনুবাদ। কলকাতা দূরদর্শন কেন্দ্রকে বাংলা অনুবাদ দেওয়া হয়নি, চেন্নাইকে দেওয়া হয়নি তামিল। তাই বাকি অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাগ্যে বরাদ্দ হয়েছে অন্যের থেকে শোনা কথা, গুজব ও বেসরকারি সংবাদ মাধ্যম। রাষ্ট্র সবার। এবং সবাইকে তাদের ভাষায় জানানো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এই মৌলিক নীতির লঙ্ঘন জলভাতে পরিণত হয়েছে। এদিকে অহিন্দিভাষী অঞ্চলে ভোট চাইতে যাবার সময়ে কিন্তু বিজেপি সেই ভাষাতে পোস্টার-ফ্লেক্স দিতে ভোলে না। ক্ষমতার যত কেন্দ্রীকরণ হবে, ততো বেশি বেশি করে আরো বেশি মানুষ প্রান্তিক হবেন।নাগরিকের দায়িত্ব নয় নিজেকে বদলে রাষ্ট্রের উপযোগী হয়ে ওঠা।  কল্যাণকামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার পরিষেবার ক্ষেত্রে ও অন্য সকল ক্ষেত্রে নাগরিকসমূহের ভিন্নতার বাস্তবতা মাথায় রেখে সেই ভিন্নতাকে ধারণ করার উপযোগী হয়ে ওঠা।  যেন এরই রূপক হিসেবে দেখা গেল যে নতুন নোট চলতি এটিএম মেশিনগুলিকে না আঁটার ঘটনা। হাজারে হাজারে এটিএম মেশিন নতুন নোট অনুযায়ী বদলাতে হলো। বদলে চলতি এটিএম মেশিন অনুযায়ী নতুন নোট বানালে হতো না?

4 Comments

Filed under বাংলা, Colony, Federalism, Hindustan, Identity, India, Language, Nation, Uncategorized

পশ্চিম বাংলার সরকারী নাম থেকে পশ্চিম বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে

এটা ক্রোধের মাটি, সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়ে হাঁসফাঁস করা মাটি। এ মাটি থুথু দেয়,উদ্গিরন করে – প্রাণ উদ্গিরন করে । আমাদের সেই মাটির উপযুক্ত হয়ে ওঠা দরকার । এই সৃজনশীল অংশটিকে সার দিতে হবেই। এই ক্রোধকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে । আমাদের বেঁচে থাকতে হবে । যেন মেনে নেওয়া, হাল ছেড়ে দেওয়া এক ঘুমে আমরা ঢলে না পড়ি । প্রকৃতি থেকে, ইতিহাসের থেকে এটি আমাদের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া একটি চ্যালেঞ্জ ।
– তাঁর স্বদেশ ফরাসী উপনিবেশ মারটিনিক প্রসঙ্গে বলছেন এইমে সেজার, মহিরুহসম দারশনিক ও রাজনীতিবিদ, নেগ্রিচুড আন্দলনের অন্যতম পিতা, ফ্রান্স ফ্যাননের গুরু ।

২ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ক্যাবিনেটে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে রাজ্যের সরকারী নাম ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে ওয়েস্ট বা পশ্চিম ছেঁটে ফেলা হবে । পরিবর্তে নাম হবে বাংলা অথবা বঙ্গ । সরকারী “ইংরেজি নাম ” হবে বেঙ্গল। উত্তর প্রদেশের নাম নর্থ না বা নর্দার্ন প্রভিন্স নয় । অন্য কোন রাজ্যের এমন এমন আলাদা ইংরেজি নাম নেই – আমাদের কেন বিশেষভাবে ইংরেজি দরকার, তা সরকার খোলসা করেননি । এই বদলের তাৎক্ষনিক কারন হল এক দীর্ঘকালীন সমস্যা । নতুন দিল্লীর সংঘ সরকার (যার “কেন্দ্রীয়” সরকার নামটি ভ্রান্তভাবে প্রচলিত) যখন কোন কারনে রাজ্যগুলির মিটিং ডাকে, তখন বক্তব্য রাখতে রাজ্যগুলিকে আহবান করা হয় ইংরেজি বর্ণমালায় রাজ্যগুলির নামের আদ্যক্ষরের ক্রমসংখ্যা অনুসারে । ফলে ডাবলু দিয়ে নাম শুরু হওয়া ওয়েস্ট বেঙ্গলকে ডাকা হয় একদম শেষে এবং অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর বক্তব্য শোনার ধৈর্য বা বক্তব্য রাখতে দেওয়ার জন্য সময়, দুইই থাকে অপ্রতুল । এই উপমহাদেশের নানা ভাষার কোন বর্ণমালাতেই ওয়েস্ট শব্দের “ও” ধ্বনিটি একদম শেষে আসে না । কেন একটি ফিরিঙ্গির অউপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়া এলাকায় ইংরেজি বর্ণমালার ক্রমতালিকা ব্যবহ্রিত হয়, সেটি আরেকটি গভীর প্রশ্ন, যে প্রসঙ্গে আজ আমি যাচ্ছি না । সম্প্রতি নতুন দিল্লীতে আন্তঃ-রাজ্য পরিষদের অধিবেশনে শেষে বলতে ওঠা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বান্দপাধ্যায়কে এক পর্যায় সময়ের অভাবের জন্য থামিয়ে দেওয়া হয় । একজন গনতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারপ্রধানকে যে নতুন দিল্লীর হাটে এই ভাবে অপমান করা যায় সময়ের উছিলা দেখিয়ে, সেটা নিয়মতান্ত্রিকতার বাইরেও ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন রাষ্ট্রে রাজ্য সরকারগুলির স্ট্যাটাসকেই বয়ান করে । আরেকটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের প্রধান নরেন্দ্র মোদীকে এই ভাবে থামিয়ে দেবার কথা নতুন দিল্লীর কেউ কল্পনা করতে পারেন?

তবুও এটা দুর্ভাগ্যজনক যে রাজ্যের নাম বদলের মত এক্তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের পিছহনে তাৎক্ষনিক কারন হিসেবে আছে এমন একটি কৃত্রিম আমলাতান্ত্রিক সমস্যা । এই একি সমস্যার কারণেই মোটামুটি ৫ বছর আগে তৃণমূল সরকারই আলাপ-আলছনার মাধ্যমে ঠিক করে যে রাজ্যের সরকারী নাম ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে বদলে হবে পশ্চিমবঙ্গ – ফলে ইংরেজিতেও আদ্যক্ষর “পি” হবার ফলে আর সবশেষে থাকতে হবে না। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে নতুন দিল্লী এই নাম বদলটিকে মান্যতা দেয়নি । এই ভেবে দেখার বিষয় যে একটি রাজ্যের নির্বাচিত প্রতিনধি ও জনগণ তাদের রাজ্যের নামও ঠিক করতে পারেনা, নতুন দিল্লীর সরকারের অনুমতি ও সীলমোহর ছাড়া । এই অগনতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নানা মাশুল বার বার দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। দিয়ে চলবে । সে যাই হোক, ওয়েস্ট বা পশ্চিমকে বাদ দেবার সিদ্ধান্ত ফাইনাল । বিধানসভার একটি বিশেষ অধিবেশনে এটি পাশ করানো হবে ।

পশ্চিমবঙ্গের সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন যে নাম-বদল আমাদের “”সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের” স্বার্থে। মজার কথা হলো, সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন বলেছেন যে পশ্চিমবঙ্গ নামটি আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং তাকে কি ভাবে মুছে ফেলা যায়? ১৯৪৭ থেকে পশ্চিমবঙ্গে নামটিও “আমরা” হয়ে উঠেছি। অতীতনিষ্ঠ ভাবে। পশ্চিমবঙ্গ নামটির ভিত্তি অন্ততঃ বাস্তব ইতিহাসে, অন্ততঃ স্রেফ “বঙ্গ”র তুলনায়। যে ঐতিহাসিক জনপদএলাকা থেকে বঙ্গ নামটির উদ্ভব, সেটি বর্তমানে পুরোপুরিই পশ্চিমবঙ্গের বাইরে, মূলতঃ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ফরিদপুর-মাগুরা-শরিয়তপুর-ঢাকা এলাকায়।

১৯৪৭-এর আগে বাংলার পশ্চিম অংশ কখনোই নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে একটি রাজনৈতিকভাবে একক ছিল না। সেটা হয়েছে ১৯৪৭-এর পরে, যখন হিন্দু প্রধান পশ্চিম অংশ আর মুসলমান প্রধান পূর্ব্ব অংশে বাংলা ভাগ হলো। ১৯০৫-এর বাংলা ভাগের ফলে উদ্ভূত বেঙ্গল-এ আজকের বিহার, ঝাড়খন্ড ও উড়িষ্যা প্রদেশে ছিল। সেই “বেঙ্গল” হলো একটি ফিরিঙ্গী কল্পনা, সেটি পশ্চিমবঙ্গ ছিল না। ১৯৫৫-তে পূর্ব্ব বাংলা পাকিস্তানের “ওয়ান ইউনিট” প্রকল্পের ফলে হয় পূর্ব্ব পাকিস্তান এবং ১৯৭১-এ জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ফলে সে এলাকা রাষ্ট্রিক ভাবে সংগঠিত হয় আজকের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে। যারা বলেন, যে পূর্ব্ব নেই, তো পশ্চিম কেন, সেই প্রসঙ্গে মনে যে ১৯৪৭-এর বাংলাদেশ ভাগ এবং তার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক প্রভাব দুই বাংলায় ভিন্ন। ১৯৫১ সালের আদমশুমারিতে জানা যায় যে খোদ কলকাতাতেই জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ পূর্বববঙ্গ থেকে দেশভাগের পরে আগত। সেই অনুপাত পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে আজ অবধি শুধুই বেড়েছে। তারা কেন এখানে, তার কারণ ১৯৪৭। “পশ্চিম” বঙ্গ সেই ঘটনার ফলাফল। রাজনৈতিক ভাবে ফিরিঙ্গী শাসনাধীন উপমহাদেশের আইনসভায় সবচেয়ে বেশি প্রতিনিধি পাঠাতো যুক্ত বাংলা। দেশভাগের ফলে দিল্লীর রাজনীতিতে বাংলা ও বাঙালির প্রান্তিকতার কারণও বাংলাদেশ-ভাগ। আমরা প্রান্তিক কারণ আমরা পুরো বাংলা নই, কারণ আমরা বিভাজিত বাংলার পশ্চিম ভাগ, পশ্চিমবঙ্গ। নাম বদলালে এই বাস্তবতা বদলাবে না। অর্থনৈতিক ভাবেও পূর্বববঙ্গের সাথে যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন হওয়াটা নানা কারণের মাঝে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অধোগমনের একটা বিরাট কারণ। ১৯৪৭ আমাদের বডি পলিটিকে, রাজনৈতিক চেতনায় ও অবচেতনে  বিশাল ভাবে বাস করে, আমরা স্বীকার করি আর না করি। অপর দিকে, পূর্ব্ব বাংলার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতার মুখ অক্ষ ১৯৪৭ নয়, ১৯৭১। ১৯৭১ প্রমাণ করে যে মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্ত্ব ভুল, কংগ্রেসী একজাতিতত্ত্বও ভুল, বরং এই উপমহাদেশের বাস্তবতা হলো বহুজাতিতত্ত্ব। জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে পূর্ব্ব বাংলার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, সেখানকার রাষ্ট্রকে বাংলার দেশ বাংলাদেশ নামকরণের মাধ্যমে সেই জাতীয় চেতনা তথা অভীপ্সাই প্রকাশ পায়। তাই ১৯৫৫-এ নাম বদলের পরেও পূর্ব্ব বাংলার সর্ব্বস্তরের রাজনৈতিক নেতারা মাঠে-ঘাটে-ময়দানে “পূর্ব্ব বাংলা” শব্দটি ব্যবহার করেছেন, কারণ সেটি বাস্তব। ১৯৭১-এর পরেও কিছু কেটে এর ব্যবহার দেখা গেছে, যেমন পূর্ব্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি অথবা চিন্তাবিদ আহমদ ছফার লেখায়। পূর্ব্বই তো নেই, তাহলে পশ্চিম কেন প্রসঙ্গে অর্থনীতিবীদ দীপঙ্কর দে বলেছেন,”আচ্ছা কোনটা ঠিক – ‘সূর্য্য পূর্ব দিকে ওঠে’ নাকি -‘যেদিকে সূর্য্য ওঠে ওটা পূর্ব দিক”? আবহমান বাংলার পূর্ব্ব অংশ যে পূর্ব্ব বাংলাই আর পশ্চিম অংশ যে পশ্চিম বাংলা, সেই সত্য খন্ডাবে কে?

প্রসঙ্গতঃ, “বাংলাদেশ” শব্দের মাধ্যমে দুই বাংলা বা বাংলার যে কোন এলাকাকে বোঝানো খুবই স্বাভাবিক ছিল এই সেদিন পর্যন্ত – রাজনৈতিক ময়দানে, সাহিত্যে, সর্বত্র। সত্যজিৎ রায় যখন পথের পাঁচালীতে হরিহরের মুখে বাংলাদেশ শব্দ বসান, গুপীবাঘা যে “বাংলাদেশ ” থেকে এসেছিলো, তখন তিনি পূর্ব্ব বাংলা বোঝাননি। বাংলার দেশ হলো বাংলা দেশ। দেশ ও রাষ্ট্রের তফাৎ বোঝা প্রয়োজন। দেশ হলো কোন গোষ্ঠীর আবাদভূমি বা হোমল্যান্ড। রাষ্ট্র হলো একটি রাজনৈতিক অবকাঠামো ও ব্যবস্থা। রবীন্দ্রনাথের “আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে”র বাংলাদেশ আজ রাজনৈতিকভাবে একাধিক রাষ্ট্রিক নিয়ন্ত্রণে পরে, যথা ভারতীয় সংঘরাষ্ট্র এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ” ও “বাংলাদেশ” এক নয়। এই সেদিন অবধি মূলতঃ পশ্চিমবঙ্গীয় বিষয় নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত হতো “বাংলাদেশ” পত্রিকা। পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশ নামটির হ্রস্যমান জনপ্রিয়তা দুঃখজনক কারণ এক্ষেত্রে আমরা এই একটি নামের মালিকানার প্রশ্নে রাষ্ট্রিক দাবিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি দেশজ দাবী থেকে। এবং যার ফলে পশ্চিমবঙ্গে “বাংলাদেশ” হয়ে গেছে “অপর” সূচক একটি শব্দ। এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কি হতে পারে।

অথচ বাংলাভাষী মানুষের আবহমান কালের  বিষ্ট্রীটিতে গত কয়েক শতকে  বিশাল হেরফের হয়নি, আজও হয়নি। বাংলা হলো ২৫ কোটি বাংলাভাষী মানুষের ঐতিহাসিক আবাদভূমি – বিশ্বের প্রতি ২৫টি মানুষের মধ্যে ১ জন
বাংলাভাষী। সর্বাধিক জনঘনত্বের একলপ্তে বিশ্বের সর্ববৃহৎ এলাকা। এ এক অনন্য ভূমি। হিমালয় ও বঙ্গোপসাগরের মধ্যে জীবন্ত নদীর, আজ ব-দ্বীপ নির্মাণের চলমান প্রক্রিয়ার এই ভূমি জীবন ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম চালিয়ে যায় প্রতিদিন, প্রতিরাত। এখানে প্রকৃতি বিধানে চলে প্রকৃতির বিধান বিরুদ্ধতা – এ রাগ, জাদু, স্বপ্ন ও সংগ্রামের ভূমি। যেমন এইমে সেজার বলেছিলেন, “বিস্ময়কর জন্ম থেকে প্রসূত এক অদ্ভুত ভূমি, এর দাম যে কোন বিগ ব্যাং-এর থেকে বেশি”। ১৯৪৭ যে ভাগ করেছিল, যার ফলাফল আজও বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে, সেই ভাগের অদূরদৃষ্টি, রাগ, বেইমানি, প্রায় মহাজাগতিক ক্রোধের মনুষ্য কারক দ্বারা বহিঃপ্রকাশ – “পশ্চিম” তারই চিরস্মারক। তাই কারো কাছে পশ্চিম হল মুছে দিয়ে ভুলে যাবার জিনিস, কারো কাছে তা আজকে বিভাজনবিভাজনের রাজনীতি করার সাধন, কারো কাছে পথ আলাদা হবার ঐতিহাসিক মাইলফলক, আবার কারো কাছে ঘুমিয়ে থাকা ভবিষ্যৎ স্বপ্নের ইঙ্গিত। এই পশ্চিম-চেতনাকে বাতিল করে দেওয়া, তা ১৯৪৭ পরবর্তী সরকারি ভারতীয় ইতিহাস ও আদিকল্প দ্বারা নির্মিত ও আচ্ছন্ন আজকের প্রজন্মের কাছে ফলে যতই আলগা ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে থাকুক, তা আসলে একটি জাতির আত্মপরিচিতি ও জাতিস্বত্বা চেতনাকে আঘাত করা, অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন এক বর্তমানকে নির্মাণ করা। পশ্চিম-বিহীন পশ্চিমবঙ্গ স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি মেকি আত্মপরিচিতি নির্মাণ করতে চায় যা পুরোপুরি আজকের রাজনৈতিক সীমানার মধ্যে আবদ্ধ – যেন-এ বিধাতা পশ্চিমবঙ্গ এলাকায় এক নতুন স্বত্ত্বা পয়দা করেছিলেন, যার  অতীত নেই কিন্তু বর্তমান ও ভবিষ্যৎ আছে। কিন্তু এই গোঁজামিল ধরা পড়ে যায় যখন মূলতঃ হিন্দু-উচ্চবর্ণ প্রধান মনীষিকান্ড সমৃদ্ধ “বাংলার” ইতিহাসে এসে পড়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ও রমেশ চন্দ্র মজুমদারের ঢাকায় অধ্যাপনা,বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের যশোরে ডিপুটি-কালেক্টরগিরি, রবীন্দ্রনাথের কুষ্টিয়ায় অবস্থানকালের সৃজনশীলতা, সূর্য্য সেনের চট্টগ্রামে সশস্ত্র বিদ্রোহ। পূর্ব্ব-বাংলা চেতনা বিহীন “বাংলা”-তে এগুলিকে ধরা যাবে নাকি এগুলি এবার থেকে বাদ? ভারতীয় সংঘরাষ্ট্রের শাসনাধীন স্বয়ংসম্পূর্ণ বানাওয়াট এক “বাংলা” আত্মপরিচিতি কল্পনায় কেউ ডুব দিতেই পারেন, কিন্তু সে পুকুরের পাড়গুলিতো সব এই “বঙ্গ/বাংলা”য় নয়।  তখন তল পাবেন, অঙ্ক মেলাতে পারবেন পূর্ব্ব-পশ্চিম ছাড়া?

পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম দরকার নিজেদের চিরন্তন আত্মপরিচিতির মৌলিক ও প্রাথমিক ধারণাগুলোকে, নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলিকে আগলে রাখতে, নিজের ঠাকুমার সঙ্গে নিজের সংযোগ না হারাতে।হয়তো পূর্ব্বে ফেরত যাওয়ার কোন পথ নেই। আছে শুধু দিল্লীগামী লং-মার্চ, বিশেষণহীন “স্রেফ ইন্ডিয়ান” হয়ে ওঠার মহা-প্রকল্পে যোগ দিতে। এই ইন্ডিয়ান এমন এক গোষ্ঠীপরিচিতি যার “প্রাচীন ইতিহাস ” আছে কিন্তু ঠাকুমা-দিদিমা চেতনা নেই। এই ইন্ডিয়াননত্ত্ব এমন এক আকারের জুতা, যার সাইজ সকলের জন্য এক, এবং এতে ফিট হতে হলে নিজের আকার বদলাতে হয়। অথচ আমাদের আকার-প্রকার তো এই ভূমি দ্বারা গঠিত – এমনকি উত্তরাধিকারে পাওয়া এমন সব আকার-প্রকার সম্বলিত যাতে এমন ভূমির ছাপ-স্মৃতি-গন্ধ যেখানে ইন্ডিয়ান তেরঙা ওড়ে না। আজকের দিনে, এই পশ্চিম নামক হুঁশিয়ারি দরকার পশ্চিমবঙ্গে এটা মনে করাতে যে সাম্প্রদায়িক চেতনা সম্পন্ন রাজনৈতিক বয়ানের কি বিষময় ফলাফল হতে পারে। পশ্চিম আমাদের মনে করায় আমরা কোন অতীত থেকে এই বর্তমানে কেমন করে পৌঁছলাম এবং আমরা ভবিষ্যতে কোথায় যাবো।

1 Comment

Filed under বাংলা, Bengal, Identity, Partition, Uncategorized

গোলাম আলির গজল সন্ধ্যার নেপথ্য রাজনীতি

গত অক্টোবর মাসে, পূর্ব পঞ্জাবের পাটিয়ালা ঘরানার প্রবাদপ্রতিম গজল গায়ক পাকিস্তানি পাঞ্জাবী নাগরিক গোলাম আলির একটি কনসার্ট অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল মহারাষ্ট্র রাজ্যের রাজধানী মুম্বই শহরে।উগ্র-হিন্দুত্ববাদী শিবসেনা দলের হুমকি ও চাপে সে অনুষ্ঠান বাতিল হয়। ফলে ক্ষমতাসীন বিজেপিকে এনিয়ে কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এই ঘোলা জলে মাছ ধরে নিজেদের  “সহনশীলতা” প্রমাণ করে  বাহবা পাওয়ার প্রচেষ্টায় জুট যায় বেশ কিছু অ-বিজেপি রাজনৈতিক শক্তি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি গোলাম আলিকে আমন্ত্রণ জানান পশ্চিমবঙ্গে এসে তাঁর অনুষ্ঠান করার জন্য। এই বছরের ১২ জানুয়ারী কলকাতার নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে ১৫০০০ শ্রোতার সামনে অনুষ্ঠিত হয় গোলাম আলির গজল সন্ধ্যা। সেদিনের সব ব্যবস্থাপনাকে ব্যক্তিগত ভাবে তদারকি করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় স্বয়ং। গোলাম আলিকে তিনি সংবর্ধনাও দ্যান। দৃশ্যতই আপ্লূত হয়ে অভিজ্ঞ গায়ক মমতাদেবীর ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, “আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি সরস্বতী রূপে আমাদের সকলের উপকার করেছেন”।  

মমতা দেবীর গোলাম আলির অনুষ্ঠানের হোতা হওয়া নানাভাবে ইঙ্গিতময়। সবচেয়ে বড় করে যে সংকেত তিনি দিলেন না হলো এই যে ভারত সংঘরাষ্ট্রের সকল এলাকায় সকল মানুষ পাকিস্তানি সবকিছুকে বয়কট করার প্রশ্নে এককাট্টা নয়, সকল এলাকায় অসহনশীলতা শক্তিগুলির খবরদারিও চলে না । উপমহাদেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক পটভূমিতে এটি অবশ্যই একটি সুস্থ ও শুভ লক্ষণ। কিনতু আমরা যদি এই অনুষ্ঠান ও পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক আরো কিছু অনুরূপ ঘটনার খুঁটিনাটি তলিয়ে দেখি, তাহলে দেখব যে ব্যাপারটি অতটা সহজ নয়। বিশেষতঃ পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরে  ধর্মনিরপেক্ষ ও  সাম্প্রদায়িক সামাজিক-রাজনৈতিক স্রোতগুলির মধ্যে যে আপাত সহজ বিভাজন আছে, তার প্রেক্ষিতে মমতা দেবীর  কিছু সংকেত ও কিছু চিহ্ন ব্যবহারের রাজনীতি কোন স্রোতগুলিকে পুষ্ট করে, সেটা পরিষ্কার করে বোঝা প্রয়োজন।

কলকাতায় পাকিস্তানি গায়ক গোলাম আলির গজল সন্ধ্যার উদ্যোক্তা ছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার।  কিনতু  পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোন দফতর? পাকিস্তানি গায়কের উর্দু গজলের যে আসলেই কোন  ধর্ম হয়না, তা বোঝাতে এটির উদ্যোক্তা হতেই পারত সংস্কৃতি দফতর বা নিদেনপক্ষে পর্যটন দফতর। উদ্যোক্তা ছিল পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও অর্থ নিগম। পশ্চিমবঙ্গের “সংখ্যালঘু”-দের মধ্যে ৯০%এরও বেশি হলেন মোসলমান। তাদের সাথে একজন পাকিস্তানি গায়কের কিভাবে কোন ‘বিশেষ’ সম্পর্ক থাকতে পারে, তা পরিষ্কার নয়, যদি না পশ্চিমবঙ্গ সরকার বোঝাতে চান যে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জনগণের তুলনায়  গোলাম আলি কোন অর্থে পশ্চিমবঙ্গের মোসলমানের বেশি কাছের। গোলাম আলির উর্দুও কোন ‘বিশেষ  সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের মোসলমানের সাথে তাকে আবদ্ধ করে না কারণ এ রাজ্যের মোসলমানের মধ্যে ৯০%এরও বেশি হলেন বাংলাভাষী, বাঙ্গালী। এই উদ্যোক্তা চয়নের মাধ্যমে যে ভাবে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের এক অংশকে স্রেফ তার ধর্মীয় (পড়ুন  মোসলমান ) পরিচিতির মধ্যে সীমিত করা হলো এবং সেই গোদা পরিচিতিটিকে বেশ প্রকট ভাবেই পাকিস্তানের আরেক মোসলমান গায়কের সাথে ‘বিশেষ ভাবে যুক্ত করা হলো, তা ভারত সংঘের রাজনৈতিক আবর্তের সাম্প্রদায়িক ধারায় মোসলমান সম্বন্ধে চালু সবচেয়ে ক্ষতিকারক  স্টিরিওটিপিকাল ধারনাগুলিকেও হাওয়া দেয়। এই ধারণার সংক্ষিপ্ত আকার হলো – মোসলমানদের পাকিস্তানের প্রতি বিশেষ প্রেম আছে। উপমহাদেশের প্রায় সকল রাষ্ট্রেই প্রধান ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে ‘অন্যের মাল’ বা ঘরশত্রু হিসেবে কল্পনা করার একটি সুদীর্ঘ লজ্জাজনক ঐতিহ্য চালু আছে, এমনকি রাজনৈতিক ভাবে যারা ধর্মনিরপেক্ষ অর্থে মন্দের ভালো বলে পরিচিত, তাদের মধ্যেও।

প্রসঙ্গত, মমতা দেবী  এই প্রথমবার  সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও অর্থ নিগমের ঢাল ব্যবহার করছেন আধা-রাজনৈতিক স্বার্থে, এমন নয়। এই নিগমেরই অনুস্থানগুলিতে তিনি ধর্মীয় সংখ্যালঘু, প্রধানত মোসলমানদের জন্য বিশেষ প্রকল্প ঘোষণা করতে করেছেন। নানা বিশেষের মধ্যে একটি বিশেষ ছিল বড়ই দৃষ্টিকটু। সেটি ছিল পশ্চিমবঙ্গে একটি বিরাট নজরুল কেন্দ্র স্থাপনার ঘোষণা (যেটি ইতিমধ্যে রাজারহাটে নজরুলতীর্থ নামে  চালু হয়ে গেছে)। নিখিল বাংলাদেশে মোসলমান ঘরে জন্মানো ব্যক্তিত্ব খুব কম ছিলেন বা আছেন যাদের প্রতিপত্তি ও যশ হিন্দু-মোসলমানের ধার ধারে না, যদিও ১৯৭১ পরবর্তী কালে (এবং কিছুটা তার পূর্ব্বেও) নজরুলকে গনপ্রজান্তন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় কবি বানিয়ে আলতো করে নজরুলকে ‘বিশেষ’ ভাবে পূর্ব্ব-বাংলার করে গড়ে তোলা হয়েছে। এই ‘বিশেষ’ এর মধ্যে ধর্মের ছাপ অনস্বীকার্য্য এবং মমতা দেবীর রকম-সকম দেখে মনে হয়, তিনিও বোধহয় নজরুলের এই ভ্রান্ত চরিত্রায়নে আস্থা রাখেন, অন্ততঃ রাজনৈতিক স্বার্থে।  একটি সংখ্যালঘু উন্নয়ন মঞ্চকে ব্যবহার করে মমতা দেবীর নজরুল সংক্রান্ত ঘোষণা আবার করে দেখিয়ে দেয় পশ্চিমবঙ্গের মোসলমান কি শুনতে চায়, সেই সম্বন্ধে তাঁর ঠিক বা বেঠিক ধারণা।

২০১৫র মে মাসে, মমতা দেবীর সরকার প্রখ্যাত উর্দু কবি আল্লামা ইকবালের নাতি ওয়ালিদ ইকবালকে কলকাতায় ডাকেন সরকারী সাহায্যে চলা পশ্চিমবঙ্গ উর্দু অকাদেমির বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষ্যে। সুদূর লাহৌর থেকে এসে তিনি তাঁর দীর্ঘদিন আগে প্রয়াত ঠাকুর্দার সম্মানার্থে দেওয়া একটি পুরস্কার গ্রহণ করেন।  আবারও, কোন উর্দু কবিকে সম্মান দেওয়ার ব্যাপারে আপত্তির কিই বা থাকতে পারে? আপত্তির কিছুই নেই।  সমস্যা হলো, তৃনমূল দল যেভাবে উর্দু ও মোসলমানকে যুক্ত করে ফেলে সেটা নিয়ে , যার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লামা ইকবালের নাতিকে এনে সেই ব্যাপারটিকে বিশাল সংখ্যক হোর্ডিং-এর সাহায্যে কলকাতার মোসলমান প্রধান এলাকাগুলিতে প্রচার করার পিছনের রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশ ও ধারণা নিয়ে। তৃণমূল দলের ২০১১সালের ঘোষণাপত্রে তারা যেভাবে মাদ্রাসা ও উর্দু স্কুলের ব্যাপারটি সহজেই একসাথে বলেছে, তা থেকেই  ধারণা পাওয়া যায় তারা মোসলমান ও উর্দু, এই দুটি ব্যাপারকে কি ভাবে দেখে। ঘোষণাপত্রে তারা প্রকট-ভাবে গুলিয়ে ফেলে মোসলমান ও উর্দু, আর তাদের অনুষ্ঠান-সম্মান্প্রদানের মধ্যে অন্তর্নিহিত থাকে  উর্দু ও পাকিস্তানকে গুলিয়ে ফেলার, এবং পরিশেষে আভাস থাকে মোসলমান ও পাকিস্তানকে গুলিয়ে ফেলার। শেষের ভ্রান্তিটিই সবচেয়ে বিপদজনক।

পশ্চিমবঙ্গের ৯০% মোসলমান  বাংলাভাষী। আল্লামা ইকবাল  বা উর্দু বা গোলাম আলি পশ্চিমবঙ্গের  হিন্দু  বাঙ্গালীর থেকে যত দুরে, ততটাই দুরের সেখানকার মোসলমান বাঙ্গালীর থেকেও। অথচ তৃনমূল দলের মোসলমান নেতৃত্ত্বের মধ্যে আনুপাতিক হারে বাংলাভাষীদের প্রতিনিধিত্ব বেশ কম। তৃণমূলের জন্মসুত্রে মোসলমান সাংসদ-দের মধ্যে ৪০% হলেন উর্দুভাষী, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের মোসলমানদের মধ্যে তারা ১০%ও না। এদেরকে নেতৃত্বে রাখার একটা সুবিধে হলো, জনভিত্তিহীন নেতাদের বসিয়ে একাধারে যেমন দলের মোসলমানদের মধ্য থেকে স্বতন্ত্র জননেতা তৈরীকে আটকানো যায়, আবার একই সাথে এই নেতাদের মোসলমানত্ব ভাঙ্গিয়ে  সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বের দায়টিও সারা হয়। পশ্চিমবঙ্গের ২৫%জনগণ হলেন মোসলমান বাঙ্গালী। সেই বর্গ থেকে উঠে আসা স্বতন্র জননেতা যে শর্তে দর কষাকষি করবেন, যে ভাবে নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারার অন্য বিন্যাস তৈরীর সম্ভাবনা ধারণ করবেন, তা প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির মধ্যে আজকে বর্তমান কায়েমী স্বার্থগুলির স্থিতিশীলতার পক্ষে বিপদ। দেশ-ভাগ পুর্ব্ববর্তি সময়ে শের-এ-বাংলা ঠিক এটিই করেছিলেন কৃষক-প্রজা পার্টির আমলে, সামন্তপ্রভু নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস ও সামন্ত্রপ্রভু নিয়ন্ত্রিত  মুসলিম লীগের ‘শরিফজাদা’ নেতৃত্বের বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে। ৭১-ও এক অর্থে এই আপাত বাঙ্গালী  ছুপা  ‘উচ্চকুল্শীল“ উর্দুপ্রেমীদের ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদের আরেকটি ধাপ। দুঃখের বিষয়, পশ্চিমবঙ্গের মোসলমান ৪৭-এর পর থেকে কোন ফজলুল হক-কে পায়নি। তাই কলকাতায় উর্দু-পাকিস্তান আপ্যায়ন করে মোসলমান -মোসলমান খেলা করা সম্ভব।  গোলাম আলীর গজল সন্ধ্যাকে বুঝতে হবে সেই পরিপ্রেক্ষিতেও । সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার কালিয়াচকে প্রায় লক্ষাধিক মোসলমান জনতা এক জমায়েত করে সুদূর উত্তর প্রদেশের এক অখ্যাত হিন্দু সাম্প্রদায়িক নেতার হজরত মহম্মদের প্রতি অবমাননাকর বক্তব্যের প্রতিবাদে। জমায়েতটি সহিংস হয়ে ওঠে এবং বেশ কিছু গাড়ি জ্বালায় এবং হিন্দু দোকান ভাঙ্গচুর করে। এই দুরের ঘটনার উপর ভিত্তি করে, সামাজিক মাধ্যমে ঘৃণার প্রচার যেভাবে এতগুলি মানুষকে এককাট্টা করলো এক সহিংস প্রতিবাদে, তা চিন্তার বিষয় কারণ রাজনৈতিক দল বহির্ভূত  এত বড় হিংসাত্বক জমায়েত প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক সংগঠনের অক্ষমতা ও মাঠস্তরে অনুপস্থিতিকেই প্রমাণ করে । যে কোন গোষ্ঠীর উপর ভিন্নতা আরোপ করতে করতে তা এক সময় ফ্র্যন্কেনস্টাইন দৈত্যে পরিণত হতেই পারে।  বরং পশ্চিমবঙ্গের মোসলমান বাঙ্গালীর আর্থ-সামাজিক ক্ষমতায়নের যে রাজনীতি, তা গজল সন্ধ্যা ও নজরুল তীর্থের চমকের মাধ্যমে সম্ভব না। কারণ তার চাহিদাগুলি বিশাল-সংখ্যক হিন্দু বাঙ্গালির থেকে আলাদা নয় – যথা  খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ইত্যাদি। এই পথটি কন্টকময় ও  লম্বা – অনেক বিরোধিতাও আসবে আশরাফ মোসলমান ও সবর্ণ হিন্দু কায়েমী স্বার্থে ঘা লাগলে। কিনতু সে কঠিন পথের কোন সহজ  বিকল্প নেই।

Leave a comment

Filed under বাংলা, Bengal, Community, Culture, Elite, Faith, Identity, Kolkata, Language, Pakistan, Partition, Polity, Power, Religion, Uncategorized

রোহিত ভেমুলা ও ঘরের কাছের অন্ধকার

১৬ জানুয়ারী ২০১৬ অর্থাৎ যেদিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি  ঘোষণা করলেন যে ২৫ কোটি টাকা অবধি দরের ‘স্টার্ট-আপ’ কোম্পানি খুলে ব্যবসা শুরু করলে ৩ বছর আয়কর দিতে হবে না, শ্রমিক অধিকার ও ভাতা ঠিকঠাক দেওয়া হচ্ছে কিনা, পরিবেশ দুষিত করা হচ্ছে কিনা, এসবের কোন কিছুরই সরকার ৩ বছর অবধি পর্যবেক্ষণ পর্যবেক্ষণ করবে না, ঠিক তার পরের দিন,  গত রবিবার একজন ছাত্র আত্মহত্যা করেছে। এরম আত্মহত্যা তো কতজন করেই থাকে, কতরকম কি হয় আজকাল – প্রেমঘটিত, অবসাদ, ‘ড্রাগস’। একজন পিএইচডি গবেষণারত ছাত্র আত্মহত্যা করেছে।  সে ক্ষেত্রে আবার যোগ হতে পারে ‘স্ট্রেস’। কিনতু তারপর যদি বলি গ্রামের ছেলে, ইংরেজি মিডিয়াম নয়, দলিত – এমন একজন আমার-আপনার শহরের নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে দু-চোখ জোড়া স্বপ্ন নিয়ে এসে আত্মহত্যা করেছে, তখুনো আমরা একটু হাতরাবো একটু ‘স্ট্রেস’, একটু প্রেম, একটু ‘ড্রাগস’। কিনতু তারপর যদি আরো বলি যে তার বৃত্তির টাকা পাঠাত সে বাড়িতে, তা দিয়ে তার বিধবা মায়ের চলত, তখন হয়ত ‘ড্রাগস’টা বাদ পড়বে। তারও পরে যদি বলি যে সে স্বাভিমান নিয়ে প্রকাশ্যেই বলত যে সে বাবাসাহেব আম্বেদকরের  আদর্শে বিশ্বাসী, সে মৃত্যুদন্ড বিরোধী – তা সে ইয়াকুব মেমনেরই হোক বা কাশ্মীরে কুনান-পোসপোড়ায় কাশ্মীরি নারীদের গণ-ধর্ষণ করা সৈন্যদেরই হোক (পরের মৃত্যুদন্ডটা হয়নি, কোন দন্ডই হয়নি) এবং সে কারণে সে ছিল আমার-আপনার রাষ্ট্রের ঠিকাদারী নেওয়া বিজেপি দলের ছাত্র সংগঠন এবিভিপির চক্ষুশূল, তালে হয়ত বলবেন ব্যাপারটি ‘গোলমেলে’। এবং আরো যদি বলি যে মৃত্যুদন্ডের বিরোধীতা করে মিছিল বার করার জন্য বিজেপির এক সাংসদের অঙ্গুলিহেলনে নতুন  দিল্লীর হুকুমে জো-হুজুরি করা এক কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য্য তাকে ছাত্রাবাস থেকে বহিস্কার করে।  যদি বলি যে তার সেই বৃত্তির টাকা, তার হকের টাকা সে পায়নি বেশ কয়েক মাস? যদি এটাও বলি যে তাকে দলিত বলে সামাজিক বয়কটের মুখোমুখি হতে হয়েছিল নতুন দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের এদেশে চলা হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে? আর কি কি তথ্য লাগবে, সত্যের আর কত পরত ছাড়াতে হবে এইটা বুঝতে যে হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানে পিএইচডি-রত ছাত্র রোহিত ভেমুলার মৃত্যু স্থুলভাবে একটি আত্মহত্যা হলেও একটি অন্য সর্বার্থেই একটি রাজনৈতিক হত্যা?

এই রাজনৈতিক হত্যা কে করেছে, তার একটা সহজ এবং চালক- দায়সারা উত্তর হয়।  সেটা হলো ‘সমাজ’। কিন্নতু  তাকে কি দলিত সমাজ মেরেছে? তাকে কি হিন্দু সমাজ মেরেছে? তাকে কি মোসলমান সমাজ মেরেছে? তাকে কি উচ্চ-বর্ণের হিন্দু সমাজ মেরেছে? বৈষম্যের পৃথিবীতে সমাজ বলে কিছু হয়না, বৈষম্যের টানাপোড়েনে, ঘাত-প্রতিঘাতে লিপ্ত থাকে নানা গোষ্ঠী, নানা সমাজ। বৈষম্যের কারণে এই বিভক্তি আবার এই বিভক্তিই হলো শক্তি। কারণ বহির্শত্রু নিপীড়ক গোষ্ঠীর বিরুধ্যে আত্মশক্তিকে সংগঠিত করার জন্য দরকার আভ্যন্তরীন ঐক্য। আর নিপিরিতের এই নিজে নিজে গোষ্ঠী তৈরী করে নিপীড়ক-কে মোকাবিলা করার প্রয়াসের বিরুধ্যে নানা পাল্টা চেষ্টা চলে, চেষ্টা চলে বৈষম্যগুলিকে বাদ দিয়ে নিপীড়কের ধান্দা অনুযায়ী বিশাল একতার দোকান খোলা, এমন দোকান যার প্রধান মালিক হবে নিপীড়ক, অংশ-মালিক হবে নিপীড়িতের মধ্যে থেকে তৈরী করা দালাল আর লাভের গুড় খাওয়া হবে সকল মানুষের ঐক্যের নাম।  নিপীড়কের ঐক্যের নানা দোকান আছে – সেসব দোকানের নানারকম নাম আছে – যেমন হিন্দুত্ব, ইসলাম, ভারত, ইন্ডিয়া, সমাজ, সুশীল, ইত্যাদি। রোহিত ভেমুলা এইসব স্বপ্ন দেখত এইসব দোকান ভেঙ্গে একদিন খোলা মাঠে মানুষের হাট-বাজার তৈরী হবে।

আমরা বঙ্গবাসী। রোহিত থাকত দূরে। সেই দূর থেকে তার বন্ধুরা জানিয়েছে যে দলিত বলে, তেলুগু মাধ্যমে পড়াশুনো করে উচ্চ-শিক্ষার স্বপ্ন দ্যাখার ধৃষ্টতা দ্যাখানোর জন্যে রোহিতকে এবং তার বন্ধুদের শুনতে হতো টিপ্পনি , হাসাহাসি করা হত মফঃস্বল গুনটুরের গন্ধ গায়ে লেগে থাকা স্বপ্নালু মানুষগুলিকে নিয়ে। আজকে চুনি কোটালের মৃত্যুর প্রায় ২৪ বছর পরে আমরা এমন এক শিক্ষা-

সংস্কৃতি তৈরী করেছি যেখানে মেডিকেল কলেজগুলিতে শহুরে আইসিএসই-সিবিএসইর রমরমা (যদিও পশ্চিমবাংলার ১০% ছাত্রছাত্রীও এইসব বোর্ডে পড়ে না), উত্কর্ষ-কেন্দ্র প্রেসিডেন্সিতে নানা বিষয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষা যাতে বাংলায় না হয়, তার পাঁয়তাড়া করা হয় এই বাংলার মাটিতে থেকে, বসে, খেয়ে মোটা হওয়া একধরনের আরকাঠি  গোষ্ঠীর চক্রান্তে, যাদবপুরের তথাকথিত ‘কুল’ বিভাগগুলি থেকে বাংলায় কথা বলাদের পরিকল্পিত ভাবে হতে হয় হীনমন্যতার স্বীকার, সেখানকার  ইতিহাস বিভাগে বাংলায় স্নাতকোত্তর স্তরের উত্তর লেখার জন্য লাঞ্চিত হতে হয় প্রতিবন্ধী ছাত্র রামতনুকে, অন্য সময়ে ভুলে যাওয়া দিনে এই রকম-ভাবেই বাংলায় লেখার জন্য হেনস্থা হতে হতে আত্মহত্যা করেছিল যাদবপুরের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী পৌলমী সাহা। এই বাংলা বাংলা করলাম এতক্ষণ কারণ বৈষম্যের জন্য  বাংলা একটা উছিলা মাত্র। বাংলা মানে শহর কম মফঃস্বল বেশি গ্রাম আরো বেশি, বাংলা মানে বড়লোক কম গরীব বেশি, বাংলা মানে হাতখরচা কম টিউশনি বেশি, বাংলা মানে গাড়ি কম সাইকেল বেশি – অর্থাৎ বাংলা মানে সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ যাকে জোর করে হারিয়ে দেবার চক্রান্ত চলছে আমাদের এই বাংলাদেশে। প্রেসিডেন্সি যত বাংলা-বিরোধী শহুরে-ইংরেজদের আখড়ায় পরিণত হবে, ততবেশী অসবর্ণ  অধ্যাপক  মহিতোষ মন্ডল লাঞ্ছিত হবেন এই-সকল ‘সুপার-কুল’ পোস্টমডার্ন আখড়ায়। মেডিকেল কলেজগুলি তত বেশি করে গুরগাঁও, নয়ডা ও ক্যালিফোর্নিয়ার ডাক্তার তৈরীর কারখানা হবে। বাংলার গণ-মানুষকে, অন্তজ জনতাকে  জোর করিয়ে হারিয়ে দেবার এই চক্রান্ত বন্ধ হওয়া দরকার। দরকার জনসংখ্যার অনুপাতে সর্বস্তরে সংরক্ষণ। দরকার বিরাট একতার বুটিক দোকান ভেঙ্গে হাট-বাজারের দাপাদাপি। রোহিত ভেমুলার  সুইসাইড নোটটি ইন্টারনেট-এ পাবেন। সেটিকে পড়ুন। বামুন-কায়েত বিপ্লবী আর রেডিকেল-দের অপরাধ-বিলাসের জন্য চে গেভারার মৃত্যু অবধি যেতে হবে না। রোহিত ভেমুলার মৃত্যু আমাদের অন্তরের অন্ধকারগুলিকে  প্রকাশ্যে আনতে সাহায্য করুক।                                        

6 Comments

Filed under Acedemia, বাংলা, Bengal, Caste, Community, Elite, Our underbellies, Scars, Science, Under the skin, Urbanity

এই বাংলায় মায়ের দুটি পা, গরুর চারটে

অনেকে হয়তো এই লেখাটি সকালে কাজে যেতে যেতে বাসে-ট্রামে-ট্রেনে-মেট্রোতে পড়বেন। কেউ হয়ত পড়বেন সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে, চান করে খাওয়ার টেবিলে। ভেবে দেখুন, খেতে বসেছেন। ফ্রীজে একটু মাংস রাখা আছে।  কাল বা পরশু রাঁধা হবে।  স্ত্রী খাবার বারছেন। বুড়া বাপ সোফায় বসে।  হঠাত শতশত লোক এসে আপনাকে, আপনার বাবাকে টেনে নিয়ে গেল। হঠাতই। তারপর অনেকে মিলে আপনাকে আধমরা করলো, আপনার বাবাকে মেরেই ফেলল।  তারপর চলে গেল। আপনার দুনিয়াটা শেষ হয়ে গেল। কারণ আপনার ফ্রিজে রাখা প্যাকেটে সেই মাংস এই খুনীদের, এই পাপীদের ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে’ আঘাত করেছে। উত্তর প্রদেশের দাদরিতে ঠিক এই ঘটনাটাই ঘটেছে।  মহম্মদ আখলাক খুন হয়েছেন। তার লাশের মাংসের চেয়ে তার ফ্রীজের মাংসকে শনাক্ত করতে যে পাপিষ্ঠদের বেশি মাথাব্যথা, তাদেরই গুরু-ভাইরা দিল্লির মাধ্যমে এই বাংলাকেও শাসান এবং কোন একদিন শাসন করার স্বপ্ন দ্যাখেন। দাদরি কোথায় জানেন? নয়ডা-তে।  সেই নয়ডা যেখানে আপনার ছেলে-মেয়েকে আপনি পাঠাতে উত্সুক, যাতে তারা ‘আরো বড়’ হয়। এইটা হলো নয়ডা। শিকড়হীন যুবসমাজের ঝিনচ্যাক আর গরুর জন্য মানুষ খুন, এই নিয়ে সেখানকার সংস্কৃতি। ভাগ্যিস ‘আরো বড়’ হইনি, রয়েছি বঙ্গবাসী হয়ে, নয়ডাবাসী হইনি।

বিহারের মানুষের বড়ই দুর্ভাগ্য।  একটা নির্বাচন যেটা কিনা তাদের সামনে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-নারী অধিকার-জাত ভিত্তিক বৈষম্য এবং আরো কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচিত হবার সুযোগ এনে দিয়েছিল, কিছু ঘৃণার কারবারী সেই নির্বাচনকে গরু-কেন্দ্রিক নির্বাচনে পরিনত করতে চায় জনগণকে ভ্যাড়া বানিয়ে। আর বাকি রাজ্যেও তারা ঢোকাতে চায় গরুর পাল, চালাতে চায় গরুর হাড়-শিং-মাংস নিয়ে ফেইসবুক, এসএমএস, হওয়াট্সয়াপের ছবি ও ঘৃণা  চালাচালির রাজনীতি। যে সময়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আয়ের দিক থেকে সামান্য এগিয়ে থাকা আফ্রিকা মহাদেশের সাথে মহাসমেল্লনে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আয়ের দিক থেকে আফ্রিকার থেকেও গড়ে পিছিয়ে থাকা ভারতীয় সংঘরাষ্ট্র গরীব জনতার টাকায় সস্তা বারফাট্টাই করে আফ্রিকাকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত ‘সাহায্য’ করার নানা চুক্তি করে, একই সময়ে আমাদের এই পোড়ার রাষ্ট্রে আত্মহত্যারত কৃষক, বেকার যুবক, ক্ষুধার্ত মা, রোগাক্রান্ত দাদু ও অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সামনে হাজির করা হচ্ছে তাদের সব সমস্যার এক দাওয়াই – গরুকে মা রূপে পুজো করা। আমরা যারা রোজ পেট পুরে খেতে পাই, যাদের আয় করার মোটামুটি একটা নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা আছে, তাদের একটা দায় আছে এই ষড়যন্ত্রের আগুনে হাওয়া না দেবার। বিজয়া দশমী সবে গেল।  সামনে কালী পুজো আসছে। তার মাঝে মানুষের জীবনের ইস্যুগুলিকে তুচ্ছ করে গরু, গরু করা একটা পাপ। আমরা বাঙ্গালী। মা দূর্গা আমাদের মা। মা দূর্গা আমাদের দ্যাখেন  এবং তিনি সব কিছুই দ্যাখেন। হিন্দুস্তানি এলাকায় গরু নিয়ে রাজনীতি দেখে এখানে কিছু লোকের মনে কি কি ফন্দি মাথায় আসছে, তিনি সেটাও দেখছেন। তিনি আমাদের হাড়ে হাড়ে চেনেন। আমাদের একটু সাবধান হওয়া উচিত। পাপ-পূণ্য বলে একটা ব্যাপার আছে – যেটা গরু-ভ্যাড়া-ছাগলের-শুয়োরের অনেক উপরে।

আমরা বঙ্গবাসী।  আমরা মাকে মা বলে জানি আর গরুকে গরু বলে জানি।  আমার মায়ের দুটো পা। গরুর চারটে পা। দুটো যাতে গুলিয়ে না ফেলি, এবং দুনিয়াকে চেনার সঠিক শিক্ষা পাই, তার জন্য আমার মা ও ঠাকুমা ছোটবেলায় আমাকে অনেকবার ‘আস্ত একটা গরু’ বলে বকাবকি করেছেন, উচিত শিক্ষা দিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে ‘শুয়ার’ বলে গালি দিয়েছেন আমাকে আমার মা।  সেই শিক্ষায় আমরা মানুষ হয়েছি। যে মা আমাকে ‘গরু’ বলে গালি দিয়ে শিক্ষা দিত, আজ কারুর প্ররোচনায় যদি গরুকে মা বলে ডাক দিই, তাহলে আমাদের মায়ের শিক্ষা ব্যর্থ। বাংলা মায়ের অযোগ্য সন্তান হবার শখ আমার নেই। আজ বাইরে থেকে নানা তত্ত্ব আমদানি করে বাঙ্গালীকে কেউ কেউ মাকে ও গরুকে নতুন করে চেনানোর ঠিকাদারী নিয়ে বাংলায় ঘনঘন যাতাওয়াত করছে। এদের যাতাওয়াতের খাই-খরচা দিয়ে বাংলার মাটিতে বসেই ১৯৪৩-র মন্বন্তরে অশুভলাভ করা গণশত্রু  মজুতদারের নাতি-পুতিরা আরেকটা মহামৃত্যু ঘটানোর ফন্দি আটছে আরো বড় মুনাফার জন্য। তারা দিল্লীর সাথে ষড়যন্ত্র করে এককালে  বাংলা ভাগ করেছে, কলকাতাকে নিংড়ে নিয়েছে, তারা রক্ত শুষেছে বাংলার মানুষের, কিন্তু তাদের রক্তের খাই মেটে নাই। পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ানক হলো অহিংসার কীর্তন করা মানুষের চোরাগোপ্তা সহিংসতা। জল বেশি দূর গড়ানোর আগেই এই খেলার নেপথ্য খেলোয়ারদের জার্সির রং, ক্লাবের তাঁবুর ঠিকানা, সব চিনে নেওয়া প্রয়োজন।  বাংলার স্বার্থে। শান্তি-রক্ষার স্বার্থে। মানবতার স্বার্থে।

বাংলার বাইরে অর্থাৎ  মুম্বই, গুরগাঁও, ছত্তিসগড়, রাজস্থান ইত্যাদি নানা জায়গায় সম্প্রতি গরু পেরিয়ে ভ্যাড়া, ছাগল ও মুরগির দিকেও হাত পড়েছে ধর্মের দোহাই দিয়ে। আমি শাক্ত, আমার চৌদ্দ পুরুষ শাক্ত, আমরা কালিঘাটে পাঠা বলি দিই মাকে তুষ্ট করতে, সেই বলির মাংস আমাদের কাছে  মায়ের প্রসাদ। সেই প্রসাদকে যারা হেয় করে, ঘেন্না করে, সেটাকে নিষিদ্ধ করে ধর্মের দোহাই দিয়ে, তাদের ধর্ম আমাদের নয়। সে ধর্মের প্রভাব থেকে মা কালী আমাদের রক্ষা করে আসছেন, করে যাবেন।  মা কালীর বাংলায় আমাদের যারা নিরামিষাশী গরু-ছাগল বানাতে চায়, তাদের ঠাঁই নাই। আজ কলকাতা শহরের বেসরকারী হাসপাতালে মুমূর্ষু রুগীকে নিরামিষ খেতে দেওয়া হয় মালিকের ধর্মীয় ‘অনুভূতি’ অনুযায়ী, চিকিত্সাবিজ্ঞানে কিছু ক্ষেত্রে আমিষ-প্রোটিন পথ্য বলে দেওয়া সত্ত্বেও।  আমাদের অজান্তেই আমাদের ঘর বেদখল হয়ে যাচ্ছে না তো ? এরা গরুতে থামবে না, এরা ছাগলে থামবে না, এরা সুজলা সুফলা বাংলাকে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান বানিয়ে তবে থামবে। শুয়োর-গরু-ছাগলের পাল যদি আমাদের এই বাংলার সোনালী-সবুজ ক্ষেতে ঢুকে শত শত বছর ধরে মানুষের রক্তে-ঘামে-ভালবাসায়-বোধে-বিশ্বাসে তৈরী করা সহাবস্থানের ফসল ধ্বংস করতে চায়, তাহলে মা কালিকে সাক্ষী রেখে কালিপটকার চেইন বাঁধা দরকার।  সে কালী পটকার চেইন লাগিয়ে দেওয়া দরকার বহির্শত্রুর ল্যাজে। তারপর আলতো করতে একটু আগুন জ্বালালেই পাপাত্মা থেকে মুক্তি। ব্যাপারটা সিরিয়াস। অনেককালের, অনেক যুগের, অনেক সিঞ্চনের, অনেক প্রেমের ফসল এই বাংলার মাটি। এই মাটিতে আমরা খাল কেটে কুমির ডাকবো নাকি এ মাটির ফসল লালন করব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বঙ্গবাসীর জন্য, সিদ্ধান্তটা আমাদের। ব্যক্তিগত ভাবে সিদ্ধান্তটা আমি নিয়ে ফেলেছি। তাই ঘরে কালিপটকা মজুত রেখেছি জন্ম থেকেই।  আসলে ওই মজুত করা কালী-পটকা আমি কিনিনি।  কিনেছিল আমার পূর্বপুরুষেরা। অনেক শতক আগে।  সেই থেকে ঘরে আছে। মাঝে মাঝে ওগুলোকে ছাদে উঠে রোদে তা দেওয়াই। কে জানে কখন কাজে লাগে। মা দুর্গাকে প্রার্থনা করি যেন কখুনো কাজে না লাগে, কিন্তু হিন্দুস্তানি এলাকার হল-হকিকত দ্যাখে আজকাল একটু ঘনঘনই ছাদে উঠি। রোদে তা দিই এবং মেঘের রং দেখি। আমরা ঘরপোড়া। অনেকের সিঁথির সিঁদুর উজাড় হয়েছে, অনেকের সম্ভ্রম লুন্ঠিত হয়েছে, অনেকের জান-মাল নষ্ট হয়েছে, ভিটামাটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে ১৯৪৭-এর আগেকার গরু-ভ্যাড়ার রাজনীতিতে। পূর্ব্ববঙ্গে সে রাজনীতি ধিকিধিকি আজও চলছে। ভিটা ছেড়ে তারা আজও আসছে এই বাংলায়। এই বাংলা যে সে মাটি নয়। আমাদের একটা দায়িত্ব আছে। রোগ না ছড়ানোর। রোগ সারানোর। মা কালী সকলের মঙ্গল করুন।

1 Comment

Filed under বাংলা, Bengal, Kolkata, Religion

ভাষা অধিকার নিয়ে চেন্নাই ঘোষণা

ভারত সরকারের  হিন্দি আধিপত্যবাদের বিরুধ্যে সকল ভাষার সম অধিকারের দাবিতে নানা ভাষার প্রতিনিধি মিলিত হয়েছিলেন তামিল নাডুর চেন্নাইতে। সেখানে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তৈরী হয় ভাষা অধিকার নিয়ে চেন্নাই ঘোষণা। ভাষা অধিকার নিয়ে চেন্নাই ঘোষণার বাংলা তর্জমা করেছেন আমাদের Promote Linguistic Equality – West Bengal গোষ্ঠীর সদস্য রৌনক। সাথীদের অনুরোধ করব, চেন্নাই ঘোষণাটিকে  দিকে দিকে ছড়িয়ে দিন।  এটিকে পড়ুন, এটিকে কেন্দ্র করে আলোচনা-সমালোচনা চলুক।

**************************

ভাষার অধিকার বিষয়ে চেন্নাই ঘোষণা

ভাষার অধিকার বিষয়ক অধিবেশন

১৯-২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ (১-২য় ভাদ্র, ১৪২২)

চেন্নাই

২০-ই সেপ্টেম্বার, ২০১৫, চেন্নাই-এ সমবেত হয়ে, যে-যে সংগঠন ও যে-যে ব্যক্তি-জন বর্তমান ‘ভাষার অধিকার বিষয়ে চেন্নাই ঘোষণা’ বা চেন্নাই ঘোষণার সাক্ষরকারী,

৯-ই জুন, ১৯৯৬, স্পেন-এর বার্সেলোনা থেকে প্রকাশিত ‘ভাষার অধিকার বিষয়ে সর্বজনীন অধিকারের ঘোষণা’-কে বিবেচনা করে, যেটা ছিল নানাবিধ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ঘোষণা, আইন-সমূহ, অঙ্গীকারপত্র এবং অধিবেশনের পরিণতি, যার মধ্যে পড়ে ১৯৪৮-এর ‘মানবাধিকার বিষয়ে সর্বজনীন ঘোষণা’, ১৯৬৬-এর ‘নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারপত্র’, ১৯৯২-এর ইউনাইটেড নেশান্স অর্গানাইজ়েশান এর সাধারণ সম্মেলন-এর ৪৭/১৩৫ প্রতিজ্ঞাপত্র, ১৯৮৯-এর ইন্টার্ন্যাশানাল লেবার অর্গানাইজ়েশান-এর বৈঠক এবং অন্যান্য, কোনো বিশেষ ভাষার বিকাশ-কে রুদ্ধ করা বা জোর করে আরোপ করা বা অন্যান্য ভাষার তুলনায় এক বিশেষ ভাষা-কে প্রচার করা এবং ভাষার অধিকার নিয়ে ভারত গণরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একাধিক ভাষা-গোষ্ঠীর সংকল্প এবং দাবী-সমূহ বিবেচনা করে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বর্তমান ভাষা-ভিত্তিক নীতি-গুলো মাথায় রেখে যা ভারত গণরাজ্যের বিবিধ সম্প্রদায়ের মুখের-ভাষার বিকাশ এবং কখনও-কখনও অস্তিত্ব-রক্ষার পরিপন্থী, ভারতের সংবিধান দ্বারা প্রদত্ত বর্তমানে প্রচলিত নির্দেশিকা-সমূহ কে বিবেচনা করে, যেখান থেকে উৎপত্তি ঘটেছে ভারত গণরাজ্যের মধ্যে ব্যবহৃত সমস্ত ভাষার সঙ্গে সম্পর্ক-যুক্ত সব আইন, নিয়ম-কানুন ও মূলনীতি, যা মোটেও ভাষাগত সমতা এবং অধিকারের ওপর নির্ভরশীল নয়, যা মোটেও বিভিন্ন ভাষাগত সম্প্রদায়ের দাবী-কে মর্যাদা দেয় না, ভারত গণরাজ্যের কেন্দ্রীয় সরকারের হিন্দী চাপিয়ে দেওয়ার কৌশল কে বিবেচনা করে, যা সর্ব-ভারতীয় স্তরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সংগঠন ছাড়াও বৃহৎ বাণিজ্যিক গণমাধ্যম ও রাজ্য সরকার-দের দ্বারা সমর্থিত ও প্রচারিত, এবং সর্বোপরি সময়ে-সময়ে নানাবিধ ভাষাগত সম্প্রদায়ের এই বাধ্যতামূলক আরোপ-এর বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ গণ-অসন্তোষ ও গণবিক্ষোভ কে মনে রেখে, উন্নয়নের তকমা দিয়ে ইংরাজী-কে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ার অভ্যাস এবং জনজীবন ও ব্যক্তিগত যাপন থেকে ভারত গণরাজ্যের মধ্যে প্রচলিত সমস্ত ভাষা-কে ছেঁটে ফেলে প্রাত্যহিক জীবনে ইংরাজীর সর্বগ্রাসী দাপট যে আমাদের ভাষাগত-সংস্কৃতিগত-অর্থোপার্জন এর সম্ভাবনার পরিসর-কে সংকীর্ণ করে – এই ব্যাপার-টা বিবেচনা করে,

এই নিম্নোল্লিখিত তিন-টে দাবী মনে রেখেঃ

১। ভারতের সংবিধান এর পরিশিষ্টের আট নম্বর তথ্য সারণি-তে তালিকা-ভুক্ত

ভাষা-সমূহ কে প্রতিনিধিত্ব করা ব্যাপক জনমানব তাদের নিজ-নিজ ভাষা-কে ভারত গণরাজ্যের কেন্দ্রীয় সরকারের সরকারি ভাষা রূপে চালু করার দাবী,

২। সেই-সব অন্যান্য অনেক ভাষা-সমূহ কে প্রতিনিধিত্ব করা ব্যাপক জনমানব-এর এই উপরি-উক্ত পরিশিষ্টে নিজ-নিজ ভাষা-কে যুক্ত করার দাবী,

৩। বিবিধ ভূমিসন্তান-দের এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠী সহ শতাধিক ভাষাগত সম্প্রদায়ের প্রত্যেক অপ্রতুল জনসংখ্যা এবং তাদের সদস্য-দের নিজ-নিজ ভাষা-কে সংরক্ষিত করা এবং বিকশিত করার দাবী,

ভারত গণরাজ্যের মধ্যে ব্যবহৃত সমস্ত ভাষা ভারত গণরাজ্যের নাগরিক-দের বৈচিত্র্যের দিকে চিহ্নত করে যার জন্য এই ভাষা গুলো ঐতিহাসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আঞ্চলিক কারণে প্রত্যেক বিশেষ-বিশেষ ভাষা সম্প্রদায়ের অঙ্গ – এই ব্যাপার-টা বিবেচনা করে,

এইটা মনে রেখে যে, ভারত গণরাজ্যের সমস্ত ভাষা ইতিবাচক পরম্পরাগত জ্ঞানের উৎকৃষ্ট সঞ্চয়-স্থান যেগুলো শত-শত বছর ধরে বিকশিত হয়েছে নিজ-নিজ আঞ্চলিক পরিস্থিতি ও চর্চার ওপর দাঁড়িয়ে যাকে হারানোর মর্ম হল প্রত্যেক ভাষাগত সম্প্রদায়ের পূর্ব প্রজন্মের থেকে পাওয়া নিজস্ব ইতিবাচক উত্তরাধিকার, জ্ঞানভান্ডার এবং পর্মপরাগত বিশেষজ্ঞতা কে বিস্মৃতির অতলে হারানো,

আমরা এহেন ঘোষণা করছি যে

ভারত গণরাজ্যের মধ্যে সমস্ত ভাষা-কে সমান দৃষ্টি-তে বিবেচনা করতে হবে এবং প্রত্যেক ভাষাগত সম্প্রদায়ের নিজ-নিজ ভাষা-কে যে-কোনো সম্ভাব্য উপায়ে সংরক্ষিত করা, বিকশিত করা এবং জোরদার করে তোলার অধিকার আছে যেমন-টা কোনো গণতান্ত্রিক পরিমন্ডলে থাকা উচিত।

ভারত গণরাজ্যের প্রত্যেক নাগরিক-এর মৌলিক এবং অ-বিচ্ছেদ্য অধিকার হচ্ছে সরকারের আমলা, বিচার-ব্যবস্থায় কর্মরত সরকারী কর্মচারী এবং জন-প্রতিনিধি দের সাথে তাঁর নিজের মাতৃ-ভাষায় সংযোগ স্থাপন করতে পারা এবং সরকারের প্রতিনিধি-রাও যেন সেই উক্ত নাগরিক-এর সাথে তাঁর মাতৃ-ভাষার মাধ্যমেই আদান-প্রদান ও সংযোগ-স্থাপন করেন। ভারত গণরাজ্যের প্রত্যেক নাগরিক-এর তাঁর নিজের মাতৃ-ভাষায় প্রথাগত শিক্ষা-গ্রহণ এর অধিকার আছে। ভারত গণরাজ্যের প্রত্যেক নাগরিক-এর তাঁর নিজের মাতৃভাষায় বাণিজ্যিক ও জন-পরিষেবা পাওয়ার অধিকার আছে।

ভারত গণরাজ্যের মধ্যে অবস্থিত সমস্ত ভাষাগত সম্প্রদায়ের একাধিক সুপারিশ ও দাবী-সমূহের ওপর ভিত্তি করে আমরা একটা ‘নতুন ভাষা কমিশন’ গড়ে তোলার আবেদন জানাচ্ছি যার কাজ হবে ভারতের সংবিধান এর ১৭ সংখ্যক অংশ এবৎ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক নির্দেশিকা-সমূহ কে পুনরায় বিচার এবং সংশোধন করে একটা নতুন ভাষা-নীতির প্রণয়ন ও প্রয়োগ।

আমরা দাবী জানাচ্ছি যে ভারত রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার নিম্নোল্লিখিত দাবী-সমূহ কে তৎক্ষণাৎ স্বীকৃতি দিক এবং মান্যতা প্রদান করুক :

১। ভারতের সংবিধান এর পরিশিষ্টের আট নম্বর তথ্য সারণি-তে তালিকা-ভুক্ত

ভাষা-সমূহ কে প্রতিনিধিত্ব করা ব্যাপক জনমানব তাদের নিজ-নিজ ভাষা-কে ভারত গণরাজ্যের কেন্দ্রীয় সরকারের সরকারি ভাষা রূপে চালু করার দাবী,

২। সেই-সব অন্যান্য অনেক ভাষা-সমূহ কে প্রতিনিধিত্ব করা ব্যাপক জনমানব-এর এই উপরি-উক্ত পরিশিষ্টে নিজ-নিজ ভাষা-কে যুক্ত করার দাবী,

৩। বিবিধ ভূমিসন্তান-দের এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠী সহ শতাধিক ভাষাগত সম্প্রদায়ের প্রত্যেক অপ্রতুল জনসংখ্যা এবং তাদের সদস্য-দের নিজ-নিজ ভাষা যাতে বিলুপ্ত বা

বৃহৎ ধারার মধ্যে বিলীন না হয়ে যায়, তার জন্য একটা বিশেষ সরকারী দপ্তরের মাধ্যমে জরুরী সহায়তা করা।

আমরা এই দাবী জানাচ্ছি যে প্রত্যেক স্তরের সরকার যেন এইটা নিশ্চিত করে যে মাতৃ-ভাষায় প্রচলিত শিক্ষা গ্রহণ এর অধিকার যেন কোনো ভাবেই লঙ্ঘিত না হয়।

আমরা দাবী জানাচ্ছি যে সমস্ত রাজ্য-সরকার যেন ইতিপূর্বে বহাল প্রশাসনিক ভাষা বিষয়ে আইন-সমূহ ও নীতি-সমূহ কে শত শতাংশ প্রয়োগ করে। যে-যে রাজ্যে এই ধরণের নীতি নেই, তারা যেন গুরুত্ব দিয়ে এই নীতি তৈরী করেন।

আমরা এই উপরি-উক্ত দাবী-সমূহ ঘোষণা করার মাধ্যমে মানবাধিকার সংগঠন, প্রথাগত শিক্ষা-ভিত্তিক ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী সহ অন্যান্য নাগরিক সম্প্রদায়ের সংগঠন, সমস্ত রাজনৈতিক দল, সংগঠন, গণ-মাধ্যম, এদের কাছে আবেদন রাখছি যেন তারা সংসদে ‘ভাষাগত সমতা এবং অধিকার বিষয়ক প্রস্তাবনা’ আনার জন্য নিজ-নিজ ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা চালান এবং সেই প্রস্তাবনা গৃহীত হওয়ার পর আমরা যেন আমাদের অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছতে পারি।

এই খসড়ার নির্মাতা-রা হলেন :

আনান্দ্ গ., কার্ণাটাক (কান্নাড়)

উমাকান্থান প., কার্ণাটাক (কান্নাড়)

কোমাক্কামবেড়ু হিমাকিরাণ আঙ্গুলা, তামিল নাড়ু (তামিল,তেলুগু)

গর্গ চ্যাটার্জী, পশ্চিমবঙ্গ (বাঙলা)

গাণেশ চেতান, কার্ণাটাক (কান্নাড়)

যোগা সিং ভার্ক, পাঞ্জাব (পাঞ্জাবী)

থামিজ়নেরিয়াঁ, তামিল নাড়ু (তামিল)

দীপাক পাওয়ার, মহারাষ্ট্র (মারাঠী)

প. পাভিথ্রান, কেড়লা (মালায়ালাম)

প্রিয়াঙ্ক্ ক.স., কার্ণাটাক (কান্নাড়)

ভাসান্ত্ শেট্টি, কার্ণাটাক (কান্নাড়)

মাণি ভ. মাণিভান্নান, তামিল নাড়ু (তামিল)

রাভিশাঙ্কার আয়াক্কান্নু, তামিল নাড়ু (তামিল)

স. সেন্থিলনাথান (আঝ়ি সেন্থিলনাথান), তামিল নাড়ু (তামিল),

সাকেত শ্রীভূষাণ শাহু, ওড়িষা (কোশালি)

Leave a comment

Filed under বাংলা, Identity, Language, Rights

ভাষা, আত্মসম্মান ও অধিকার – পা চাটতে লাগে শুধু জিভ

পুরো দুনিয়া জুড়ে ব্যবসার একটা প্রাথমিক নিয়ম আছে।  ইংরেজিতে এই নিয়ম-কে বলে ‘কাস্টমার ইজ কিং’ অথবা ‘কাস্টমার ইজ  অলওয়েজ রাইট’। এর ভাবার্থ হলো, কোন পরিষেবা দানের ক্ষেত্রে, গ্রাহকের সুবিধে-অসুবিধে, সেইটাই আসল। যে পরিষেবা দিচ্ছে, যেহেতু যে গ্রাহকের থেকে টাকা নিচ্ছে, তাই তার দায়িত্ব হলো গ্রাহক-কে তার সুবিধে মত পরিসেবা দেওয়া। গ্রাহকের কাজ নয় পরিষেবা-দাতার সুবিধে মত ছাঁচে নিজেকে তৈরী করা। দুঃখের বিষয় হলো, নিখিল বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ শহর আমাদের এই কলকাতায় এই নিয়মটি বাঙালিদের ক্ষেত্রে খাটে না। একটু ভেঙ্গে বলি।  

সম্প্রতি আমি প্লেনে চেপে চেন্নাই গেছিলাম।  দমদম বিমানবন্দরে পৌছনোর পর ঘোষণায় জানলাম যে গেটটি থেকে প্লেন ছাড়ার কথা ছিল, সেটি পাল্টে গেছে।  আমাকে যেতে হবে আরেকটি গেটে।  অগত্যা তাই গেলাম। আমি ছিলাম প্লেনে ওঠার লাইনের একদম শেষের দিকে।  আমরা সকলে প্রায় প্লেনে উঠে পরেছি তখন দেখলাম একজনকে বেশ ধমক দিতে দিতে একজন এয়ার ইন্ডিয়া কর্মী আমাদের লাইনের দিকে দেখাচ্ছেন।  উনি বেশ অপদস্থ ও লজ্জিত বোধ করে গুটি গুটি আমাদের লাইনের দিকে এগিয়ে এলেন। আমি ওনাকে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করলাম।  উনি আমাকে জানালেন যে উনি বাংলা জানেন কিন্তু ইংরেজি-হিন্দী জানেন না। না জানতেই পারেন। অধিকাংশ বাঙালি-ই ইংরেজি-হিন্দি জানেন না।  বিশ্বজুড়ে অধিকাংশ মানুষই নিজেদের মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষা জানেন না। না জানাটা অপরাধ নয়। অধিকাংশ রুশ, অধিকাংশ জাপানি, অধিকাংশ চীনা মানুষ-ই নিজেদের মাতৃভাষাই শুধু জানেন। যেহেতু এই বাংলার সর্ববৃহৎ শহরের সর্ববৃহৎ বিমানবন্দরে এই বাঙ্গালীটি শুধু বাংলা জেনেই ঢুকে পড়েছেন প্লেনে চাপতে, তাই স্রেফ হিন্দি ও ইংরেজি-তে করা ঘোষণাগুলি উনি ঠিক ধরতে পারেননি। ফলে পুরনো গেটেই এদিক সেদিক করছিলেন। তারপর সেখানে চেন্নাই-এর প্লেন ছাড়ার কোন চিহ্ন না দেখে শেষে একে তাকে জিজ্ঞেস করে এই নতুন গেটে এসছেন।  যেহেতু দেরি করে এসছেন, তাই যে এয়ার ইন্ডিয়াকে উনি গুনে গুনে প্লেনে চড়তে অনেক টাকাই দিয়েছেন, তারা তাকে দেরি করার জন্য ধমক দিচ্ছিলেন।  উনি লজ্জা করে আর বলে উঠতে পারেননি যে উনি হিন্দি-ইংরেজি জানেন না।  আসলে লজ্জা পাওয়ার কথা এয়ার ইন্ডিয়ার।  যে কোম্পানি কারুর থেকে কড়ায়গন্ডায় টাকা বুঝে নিয়ে গ্রাহকের নিজের ভাষায় তাকে পরিষেবা দিতে অস্বীকার করে। আর লজ্জা পাওয়ার কথা আমাদের – যারা বাংলায় বসে বাঙালির সাথে এয়ার ইন্ডিয়ার এই হিন্দি-ইংরেজি খবরদারি নীতিকে  স্বাভাবিক মনে করি এবং স্রেফ বাংলা জানা বাঙালির হিন্দি-ইংরেজি না জেনেই তার নিজেদের দেশ বাংলার মাটিতে গড়া বিমানবন্দরে এসে প্লেনে চড়ার ‘ধৃষ্টতা’কে অস্বাভাবিক মনে করি।

আমরা ভারতীয় ইউনিয়ন নাম এক অদ্ভূত রাষ্ট্রের অধীন। এখানে সরকারী এয়ারলাইন কোম্পানি, যা কিনা অনেকের মতই বাঙালির দেওয়া টাকার ভর্তুকি-তে চলে, এলাকার মানুষকে এলাকার ভাষায় পরিষেবা দিতে চায় না। বলে নিয়ম নেই।  আসলে এই নিয়ম ভারত সরকারের।  এ নিয়ম সচেতন।  এ নিয়ম এই রাষ্ট্রে হিন্দি-ইংরেজি ভাষী ছাড়া আর সকলকে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক করে রাখার এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।  এই নিয়মতন্ত্র চলছে আমার আপনার টাকায়। এই নিয়মকে অনেক উড়ুক্কু বাঙালি সঠিক মনে করেন। আমাদের মতো নির্লজ্জ ও ক্ষমতার পা-চাটা জাত আর হয় না। বাঙালি এলিট-রা এককালে ইংরেজ-দের পা চাটত, এখন তারা পা চাটে দিল্লীর।  এই পা চাটার মাধ্যমেই স্রেফ নামে একটি বাঙালি শ্রেণী সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রাণে-বচনে-যাপনে বাঙালিদের দাবিয়ে রেখেছে। এই শ্রেনীর উত্খাত এমন এক মঙ্গলময় প্রকল্প যাতে বঙ্গলক্ষ্মীর আশীর্বাদ থাকবে বলে আমি নিশ্চিত।

ওই প্লেন যাত্রায় বাঙালির বিড়ম্বনা এখানেই শেষ না।  প্লেন যাচ্ছে বাংলা থেকে তামিল নাডু।  প্লেনের অধিকাংশ যাত্রীর মাতৃভাষা হয় বাংলা কিম্বা তামিল।  কি করে সিট-বেল্ট বাঁধতে হয় থেকে শুরু করে বিপদ হলে কি কি করতে হবে, এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলি এই সরকারী প্লেনে বাংলা বা তামিল, কোন ভাষাতেই বিমান-সেবিকারা ঘোষণা করলেন না। এমনকি লিখিত অবস্থাতেও সেটি সে তথ্য কথাও ছিল না। যে সরকার তার নীতির অংশ হিসেবে বাঙালি ও তামিলদের সুরক্ষা নির্দেশাবলী শোনায় হিন্দি-তে, সে সরকার আর যাই হোক বাঙালি বা তামিলের প্রাণ ও সুরক্ষা নিয়ে চিন্তিত নয়। তাহলে এ কেন্দ্রীয় সরকার আসলে কার? যাদের ভাষায় তারা সুরক্ষা নির্দেশ দিল, তার। আমার বলতে লজ্জা করছে যে মধ্য-প্রাচ্য থেকে অনেক বিমানে চড়ে আমি কলকাতা এসছি, যেখানে প্লেনের নানা অংশে নানা নির্দেশ (যেমন দরজায় লেখা ‘টানুন’ বা ফ্লাস করতে কোথায় টিপতে হবে) বাংলা-তামিল-হিন্দি-আরবী-ইংরেজি এমন অনেক ভাষায় লেখা থাকে। কেন? তাদের কাছে বিমান একটি পরিষেবা, যেখানে তারা গ্রাহকের সুবিধা করতে চায়। আমার দেশ যে রাষ্ট্রের অধীন, তারা দুরদর্শন থেকে ব্যাঙ্কের পাশবই  থেকে সরকারী বিমানের সুরক্ষা নির্দেশ, সবখানেই হিন্দি প্রচারের মাধ্যমে তেরঙ্গা জাতীয়তাবাদ প্রচারে ব্যস্ত। ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্রের স্লোগানের নাম যে জুয়াচুরি অ-হিন্দিভাষীদের সাথে চলেছে দেশভাগের পর থেকে, তার হিসেব কি আমরা নেব না? আমরা নিজেদের কাছে আর কত ছোট হবো? এ কোন একতা যা বজায় রাখতে আত্মসম্মান বন্ধক রাখতে হয়? একতা চাই – এমন একটা, তার পূর্বশর্ত হবে পারস্পরিক সম্মান।

প্লেনে যে ওঠে, সে শুধু বাংলা জানুক বা ইংরেজি পণ্ডিত হোক, নিখিল বাংলাদেশের নিরিখে সে একজন এলিট। সেখানেই যদি ভাষার ক্ষেত্রে এমন করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়, একবার ভেবে দেখুন রোজকার সেই অভিজ্ঞতাগুলির কথা – যেখানে বাংলার সীমান্তের বিএসএফ, কলকাতার মেট্রোতে রেল পুলিশ, বর্ধমানে সরকারী বেঙ্কের ম্যানেজার এবং আরো অনেকে যারা নাকি আমাদের ‘পরিসেবা’ দ্যান বাংলা না জেনেই। উত্তরপ্রদেশে হিন্দি না জেনে এই কাজগুলি করতে চাইলে স্থানীয় মানুষ তাদের কি অবস্থা করত, সেটা নাই বললাম। অনেকেই এসব শুনে বলবেন – হিন্দী তো রাষ্ট্রভাষা বা জাতীয়ভাষা। তাদের জানিয়ে রাখি, হিন্দি রাষ্ট্রভাষা নয়, জাতীয় ভাষাও নয়। এগুলি রাষ্ট্র হিতার্থে চালু গুজব। গুজরাট হাইকোর্ট রায়তে জানিয়েছেন যে গুজরাটের ক্ষেত্রে হিন্দী ‘ফরেন’ বা বিদেশী ভাষা। আর রয়েছি আমরা। এমন এক জাতি, যারা কোথাও ঢুকতে গেলে দরজা খুলতে বলিনা, দরজার ফাঁক দিয়ে নিজেকে বেঁকিয়ে গলানোর চেষ্টা করি। এই বাঙালিই বাংলার মাটিতে টেক্সীকে হাত দেখিয়ে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করে ‘যায়েগা?’। চম্পারন বা ভোজপুর জেলা কলকাতায় গতর খাটতে আশা আমার সেই টেক্সী-চালক ভাই-এর ভাষা যে হিন্দি নয়, ভোজপুরি, আমরা তাও জানিনা। এও জানিনা যে সে বাংলা বোঝে। দিল্লি-তে তো কত বাঙালি শ্রমিক কাজে যান – কোন হিন্দিভাষী সেখানে তাদেরকে বাংলায় হাঁক দ্যান?

সম্প্রতি মহারাষ্ট্র সরকার নিয়ম করেছেন যে নতুন অটো-রিক্শ পারমিট পেতে হলে মারাঠি বলতে জানতে হবে। কোন প্রতিবাদ হয়নি এ ঘোষণার কারণ এটি স্বাভাবিক। সেখানে অধিকাংশ অটো-চালকের মাতৃভাষা মারাঠি নয়। তারা বাইরে থেকে আসা।  কিন্তু তারা জানে না এক্ষেত্রে যাকে পরিসেবা দেওয়া হচ্ছে, সেটাই অগ্রধিকার পায়। সেই বহিরাগতরাও মারাঠি শিখে নিয়েছে এবং সৎভাবে রোজগার করে খাচ্ছে। এটা এই বাংলায় সম্ভব না। কারণ এর জন্য লাগে আত্মসম্মান ও শিরদাঁড়া।  পা চাটতে লাগে শুধু জিভ।

Leave a comment

Filed under বাংলা, Bengal, Language, Power, Rights

কলরব ও সংহতির জাতবিচার

কদিন আগে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের উপর সরকার মদতপুষ্ট ‘শিক্ষাকর্মী’ ভেকধারী কিছু গুন্ডা বর্বর আঘাত নামিয়ে আনলো। শুনছি এস.এফ.আই এবং ডি .ওয়াই.এফ.আই-এর টগবগে তরুণ-রা নাকি এতে ভীষণ ক্ষুব্ধ। এই উঠতি চে গুয়েভারারা ধুতি-পাঞ্জাবী পরে কয়েক দশক ধরে হোলটাইম স্তালিনবাদ করা পার্টি শিরোমনীদের জিজ্ঞেস করে দেখলে পারেন যে এই মারকুটে ‘শিক্ষাকর্মী’দের মধ্যে কারা কারা ৫ বছর আগেও কর্ডিনেশন কমিটির সদস্য ছিল এবং নিয়মিত কিনতো ‘সংগ্রামী হাতিয়ার’? অতীতের শুরু ১৯১৭-তে না, ২০১১-তে তো নয়ই।  তা সে যাই হোক, বর্ধমানের ঘটনার  প্রতিবাদ করতে পশ্চিমবঙ্গের
‘স্বশাসিত’ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ‘স্বাধীন’ উপাচার্য্যরা যে লাইন দিয়ে নিন্দামূলক বিবৃতি দেবেন না, সেটা বলাই বাহুল্য।  ঘটনাটা সত্য কি অসত্য, কুকুর মানুষকে কামড়েছে না মানুষ কুকুরকে কামড়েছে, এই বিতর্কে তেরঙ্গা ঝান্ডাধারী ‘শিক্ষাকর্মী’দের দ্বারা ছাত্রীদের প্রহার ও শ্লীলতাহানি শীঘ্রই চাপা পড়ে যাবে। বর্ধমানের সত্য জানতে কোন ‘রাষ্ট্রীয়’ চ্যানেলের ওবি ভ্যান ছুটে যাবে  না সেদিকে। ‘সত্যমেব জয়তে’ হলো ভারতীয় রাষ্ট্রের স্লোগান – অর্থাৎ শুধু সত্যেরই জয় হবে। যেটা উহ্য, তা হলো এই ‘সত্য’ পয়দা করার মেশিনগুলির মালিকানা যাদের হাতে, জয় হবে তাদেরই।

কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। এই যে বর্ধমানের ঘটনা, বা সবং সজনীকান্ত মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র কৃষ্ণপ্রসাদ জানার খুন হবার ঘটনা, এগুলি নিয়ে কোন ‘কলরব’ হয় না কেন? এর কারণ কি ? বড় শহর থেকে দূরের ঘটনা বলে? ইংরেজিতে জ্বালাময়ী ও ক্ষুরধার বক্তব্য ফেইসবুকে তারা দেয়নি বলে ? এখান থেকে পাশ করে তারা দিল্লি-মুম্বই-বিলেতের নানা জায়গায় প্রাক্তনী-চক্র তৈরী করতে পারেনি বলে? আমাদের এই সংহতির জাতপাত, পাশে দাঁড়ানোর বাছ-বিচারের সাংস্কৃতিক রাজনীতিকে বুঝতে হবে। নইলে আমাদের বর্ধমানে শ্লীলতাহানিগুলি, সবং-এ খুন গুলি চিরকাল থেকে যাবে ব্রাত্য, ঠিক যেমন মোমবাতি সংহতি থেকে ব্রাত্য থেকে যায় দলিত মেয়ের উপর গণধর্ষণ। আর এফ.টি.আই.আই-গজেন্দ্র বা ‘নির্ভয়া’ ঘটনার ‘সচেতন’ সংহতির কলরবে হারিয়ে যায় ‘বাকিরা’,
সংখ্যাগরিষ্টরা – ইংরেজির ক্রাচ ব্যবহার করে ‘গভীর’ মনোভাব প্রকাশে যারা এখুনো সাবলীল হয়ে ওঠে নি – তারা।

মনে পরে যাদবপুরের কলরব? সে ঘটনার সংহতিতে দিল্লীর জহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ে, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে, পুণের ফিল্ম ইনস্টিটিউটে এবং গরিব দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দ স্বল্প তেলের বেশিরভাগ অংশ যেসব টাকে লাগানো হয়, সেইরকম সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংগঠিত হয় সংহতি আন্দোলন। যাদবপুরের পাশে থাকা। পুণের ফিল্ম ইনস্টিটিউট-এ সরকার সত্যবাদী গজেন্দ্রকে বসিয়ে জায়গাটাকে একটু আয়ত্তে আনতে চাইছে, আবার সংগ্রামের দিনে পাশে থাকা মানুষগুলিকে কিছু উচ্চপদে বসিয়ে কৃতজ্ঞতাও জানাচ্ছে – যেমনটা জনগনের সম্পত্তিকে বাপের মাল তথা লুঠের মাল মনে করা দলগুলি মনে করে থাকে চিরকাল। তার প্রতিবাদ করেছে ফিল্ম ইনস্টিটিউট-এর শিক্ষার্থীরা। তাদের যারা পাশে দাঁড়িয়েছে, তাদের মধ্যে বলিউডের প্রধান তারকাদের মধ্যে খুব কম মানুষই আছেন। এই মর্মে হলিউডের সাথে তুলনাটা জরুরি, যেখানে নানা সাধারণ রাজনৈতিক প্রশ্নে ফিলিম জগতে গুরুত্বপূর্ণ অনেকেই রুপোলি পর্দার আড়ালে নিজেদের ঢেকে রাখেন না। চার্লি চ্যাপলিন থেকে সুসান সারান্ডন – নিজ রাষ্ট্রের দ্বারা সংগঠিত অত্যাচারের প্রতিবাদের মাধ্যমে এরা দেখিয়েছেন যে চলচ্চিত্র একটি মাধ্যম মাত্র এবং চলচ্চিত্র-জগতের সাথে জড়িত বলেই সেটাই তাদের একমাত্র মাধ্যম নয় – অন্য সকলের মতই, তাদের মুখ আছে, হাত আছে, পা আছে। হিন্দী ফিল্ম সংস্কৃতির টপ লোকেরা অবশ্য কংগ্রেসী টুপি পরে ১৯৮৪-র শিখবিরোধী দাঙ্গায় প্ররোচনা দিতে অথবা মদ্যপ অবস্থায় ফুটপাথবাসীদের গাড়ির তলায় পিষে দিয়ে খুন করতেই বেশি ভালবাসেন (গুজরাট পর্যটন সংস্থার দালালি করে বা অনাথাশ্রমে ছিটে ফোঁটা দান করে সেসব পাপ ঘোঁচে না), তাই এই ধরনের জীবগুলির থেকে কোন ধরনের সংহতি আশা করা শক্ত। তবে পুণের পাশে আছে এলিট নানা বিশ্ববিদ্যালের ছাত্র-ছাত্রীরা, কলরবিরা, মতলবিরা এবং আরো অনেকে। জহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু হলে সংহতি জানায় প্রেসিডেন্সি, সেখানে কিছু হলে পাশে দাঁড়ায় যাদবপুর। এরা অনেকেই একে অপরকে চেনে, পৌছে যায় একে অপরের কাছে, একে অপরের হোস্টেল-এ ওঠে, পাশে থাকে, সাথে থাকে, এলিট প্রতিষ্ঠান-জাত বুঝে নিয়ে এক থালায় খাবার খায়। খবর ছড়ায় প্রাক্তনিদের মধ্যে, সংবাদ-মাধ্যমের ‘সিনিয়র’দের মধ্যে। এইটে হলো একরকম সাংস্কৃতিক পুঁজি – যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে উচ্চ-কুল-শীলের আল্পনা আঁকা।   কিন্তু তারপর সংহতির বৃত্ত বাড়ে না – খুজতে থাকে সেই চেনা এলিট-দের, চেনা ভাষ্য, চেনা ভাঁজ, চেনা স্লোগান, চেনা অবিন্যস্ততা – অসাধারণ ও ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনে তাই ‘সাধারণ’দের কোন জায়গা নেই। যাদবপুরের পাশে মফস্স্বল থেকে অনেকে এসে দাঁড়াতে পারে বৃষ্টির দিনে – যেন সেটা তাদের দায়িত্ব, কিন্তু বর্ধমানের পাশে গিয়ে যাদবপুরের দাঁড়ায় না – দূরত্বটা এক, তবে সংহতির গতিপথটা একমুখী।

যখন নানা বিষয়ে রাষ্ট্রের, সরকারের, সরকারী দলের নিপীড়ন ও নগ্ন স্বেচ্ছাচারিতায় গণমানুষ আক্রান্ত হয়, তখন এলিট সংহতির বৃত্ত তৈরী করে ক্ষুদ্র বৃত্তে বাহবা ও অন্যান্য জিনিস পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু তার থেকে দীর্ঘমেয়াদী বা দায়িত্বশীল কিছু আশা করা অনুচিত। তারা ক্যাম্পাসে ‘ফ্রীডম’ চান, সেই ‘ফ্রীডম স্ট্রাগেল’-এ জনমতকে আবার পাশেও চান, আবার সবং-এর মতো ‘আনকুল’ নামের জায়গার ‘সাধারণ’ কলেজের নৃশংসতার পাঁকে ঢুকতে চাননা, পরমহংসের মত গা না ভিজিয়ে ডুব দিতে চান গভীর জলে। সত্যই তো তাদের স্পেশ্যাল কোন দায় নেই, কিন্তু স্পেশাল দায় আছে বৃহত্তর সমাজের, তাদের কষ্টকে বোঝার। ‘আমাকে আমার মত থাকতে দাও’ এই সময়ের শিক্ষার্থী এলিটের জাতীয় সঙ্গীত। মরুঝড়ের মাঝে এলিট মরুদ্যানের নেটওয়ার্ক বানিয়ে কোন প্রলয় কখুনো বন্ধ হয়েছে আজ অবধি? একটা পুরনো সময়ের কিছু লাইন মনে এলো – ‘আমরাও তবে এই ভাবে, এ মুহুর্তে মরে যাবো নাকি, আমাদের পথ নেই আর, আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি..পৃথিবী হয়তো গেছে মরে, আমাদের কথা কে বা জানে, আমরা ফিরেছি দোরে দোরে, কিছুই কোথাও যদি নেই, তবু তো কজন আছি বাকি, আয় আরো হাতে হাত রেখে, আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।”  বাংলার এলিট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে চাহ্ত্র-ছাত্রীদের আর্থ-সামাজিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়াও মিল রয়েছে সেখানে অবশিষ্ট অবাধ গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চায়। এর একটা বড় কারণ হলো যে এলিট নেটওয়ার্ক-এ থাকলে কলেজ পরবর্তী সময়ে শাসকদলের ল্যাজ না ধরেও ঠিকঠাক কেরিয়ার বানানো সম্ভব। এই তুলনামূলক নিরাপত্তার ফলে যে সাহসটুকু আসে, তাতে হিস্যার দাবি কি করতে পারে না
‘সাধারণ’রা? দিল্লী-পুণের হ্যেপ ও কুল বৃত্তের বাইরে অন্য জাতের হাত ধরতে এতো কুন্ঠা কিসের? এই প্রবন্ধটি কলরব বিরোধী নয়। এলিট না হয়েও স্রেফ
রবাহুত হয়ে যারা কলরবের পাশে দাঁড়ায়, তাদের জন্য কলরব হয় না কেন, মূলতঃ প্রশ্ন সেটাই।

Leave a comment

Filed under Academia, বাংলা, Bengal, Elite, Media

আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের দেশ, এবং আমাদের সংগ্রামে আজ অবধি গড়ে তোলা যা যা আছে

জুলাই মাসের প্রথম দিকটি মণিপুরের ইম্ফল এলাকায় চলল টানা গণ-আন্দোলন। গণ-আন্দোলনের প্রত্যুত্তরে ভারতে রাষ্ট্র-যন্ত্র মণিপুর বা কাশ্মীর গোছের এলাকায় যা করতে অভ্যস্ত, তাই করলো। অর্থাৎ কারফিউ জারি করলো, নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের সশস্ত্র রাষ্ট্র-শক্তি বেধড়ক মার দিলো দিনের পর দিন, একজন তরুণ আন্দোলনকারী যার নাম রবিনহুড, তাকে গুলি করে পুলিশ হত্যাও করলো। মণিপুরের এই আন্দোলনের একদম সামনের সারিতে রয়েছে হাজার হাজার রাজনৈতিক চেতনা-সম্পন্ন স্কুল ছাত্র-ছাত্রী। তারা পুলিশের মার খেয়েও নিজেদের জাতির ও সংস্কৃতির অস্তিত্ব-রক্ষার দাবি, অর্থাৎ ‘ইনার লাইন পারমিট’ প্রচলনের দাবি নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। যখন ‘ইন্ডিয়া’র ‘কুল ও ট্রেন্ডি’ টিনেজারেরা তাদের ‘এস্পিরেসনাল’ বাপ-মায়ের সুশিক্ষায় ‘পার্সোনাল স্পেইস’, ‘টিম ইন্ডিয়া’ এবং মল-মাল্টিপ্লেক্সে বিভোর থেকে তাদের সমাজ-সচেতনতার পরিচয় দিচ্ছে, ঠিক তখুনই তাদের মণিপুরী ভাই-বোনেরা জানান দিচ্ছে যে তারা অন্য ধাতু দিয়ে গড়া। মণিপুরী কিশোর-সমাজের এই রাজনৈতিক ভাবে পরিপক্ক ও বিস্ফোরক আন্দোলন নিয়ে আমাদের কিসুই আসে যায় না কারণ, এক, মণিপুরে যে কিছু ঘটছে, সেটাই আমাদের ভাবনার মধ্যে নেই, দুই, ‘ইনার লাইন পারমিট’ জিনিসটি কি, তা আমরা জানিনা, তিন, এতে ভারতীয়ত্বের কোন নামগন্ধ নেই, তেরঙ্গা দ্বিচারিতাও নেই, মোমবাতি নেই, সেলফি তোলার সুযোগ নেই। অতয়েব আমরা এতে নেই। তবু একটু খোঁজ নেওয়াই যাক না, কেসটা কি।  কারণ স্কুল-ছাত্র রবিনহুডকে খুন করা হলো যে ‘আইনরক্ষা’র নাম, সে আইন তো আমার-আপনার সম্মতিতে তৈরী বলেই বৈধতা দাবি করে।

ইনার লাইন পারমিট বা আই.এল.পি হলো অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড (ডিমাপুর বাদে) এবং মিজোরামে ঢোকার জন্য এইসব এলাকার বাইরের ভারতীয় নাগরিকদের জন্য আবশ্যিক একটি সরকারী ছাড়পত্র। এই আন্দোলন মণিপুরেও আই.এল.পি প্রবর্তনের দাবিতে, যার নেতৃত্বে রয়েছে জয়েন্ট  কমিটি অন আই.এল.পি সিস্টেম নামক দোল-নিরপেক্ষ নাগরিক-রাজনৈতিক জোট। আজকে যে অঞ্চল ‘উত্তর-পূর্ব্ব’ নামে পরিচিত, উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে ফিরিঙ্গিরা এই এলাকার স্বাধীন রাজ্যগুলিকে দখল করছিল এবং তাদের তৈরী ইন্ডিয়া-র মধ্যে সেগুলিকে জুড়ে দিচ্ছিল নানা অসৎ উছিলায়। যেহেতু এই এলাকায় স্বাধীন অসম-কে দখল করে  সেখানে চা সমেত নানা ব্যবসা শুরু করলো ফিরিঙ্গিরা, তাদের এই ধান্দাকে সুরক্ষিত করতে তারা আনলো আই.এল.পি।  এর ফলে অসমকে ঘিরে থাকা এলাকার (অর্থাৎ আজকের অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড ও মিজোরাম) মধ্যে বাইরের কেউ শুধু অনুমতি সাপেক্ষে ঢুকতে পারতো। ওই এলাকার মানুষজন মোটামুটি স্বায়ত্ত-শাসন-ই চালাত ( যা ছিল বাংলা বা বিহারের মতো সোজাসুজি ভাবে ফিরিঙ্গি-শাসিত এলাকায় কল্পনাতীত), দিল্লী বা লন্ডনের নাক গলানো ছিল নগন্য। বদলে ওই এলাকার রাজ্য তথা জন-গোষ্ঠীগুলিও অসমে ঢুকে পড়ত না এবং ফিরিঙ্গি সরকারের জন্য নিরাপত্তা খাতে খরচা ও মাথাব্যথা কমে গেছিল।  এর ফলে অসমে অর্থনৈতিক মুনাফা প্রকল্পে ফিরিঙ্গিরা সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করতে পেরেছিল। এই এলাকারগুলির ‘স্বরাজ’ অবলুপ্ত হলো ১৯৪৭-এ দিল্লী-রাজ শুরু হবার পর থেকে। ১৯৪৯-এ মণিপুরের অনির্বাচিত মহারাজা-কে শিলং-এ গৃহ-বন্দী করে, ভারতীয় বাহিনীর কুচকাওয়াজের মাধ্যমে ভীতি প্রদর্শন করিয়ে ভারতের মধ্যে মনিপুর-কে জুড়ে দেবার চুক্তিপত্রে একপ্রকার তার পূর্ণ সম্মতি ছাড়াই সই আদায় করা হয়। অথচ এই সময়ে মণিপুরে জনগণের দ্বারা অবাধ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত একটি সার্বভৌম সরকার বর্তমান ছিল, যারা কিনা সম্পূর্ণ-ভাবে মনিপুরের আলাদা অস্তিত্ব বজায় রাখার পক্ষপাতি ছিল। সেই  নির্বাচনে ভারত-পন্থী কংগ্রেসীরা লড়েছিল কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। প্রজা শান্তি দলের নেতৃত্বে, কংগ্রেসকে পর্যদুস্ত করে গড়ে উঠেছিল সেই মণিপুর সরকার – মহারাজা ছিল স্রেফ আনুষ্ঠানিক প্রধান।যেহেতু নেহরুর ভারত ছিল প্রবলভাবে গণতান্ত্রিক, তাই তারা মনিপুরকে জুড়ে নেবার সাথেই সাথেই মনিপুর-বাসীদের নির্বাচিত নিজস্ব সরকারকে বরখাস্ত করে দেয় ! আফ্স্পার মাধ্যমে মিলিটারি শাসনের প্রেক্ষাপটে ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এই নয়া গনত্রন্ত্র এগিয়ে চলেছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে, ‘এনকাউন্টার’ খুনের নিরালা পরিবেশে খাকি উর্দির কঠিন নজরদারিতে।

মণিপুরে আগে থেকে আই.এল.পি নেই কারণ এই রাজ্য কখুনো ফিরিঙ্গী শাসনাধীন ছিল না। যে সময়ে ফিরিঙ্গিরা এই এলাকায় তাদের দখলদারি ও শাসন বাড়িয়ে তুলছিল, মণিপুরের  সার্বভৌম মহারাজারা ছলে-বলে-কৌশলে ফিরিঙ্গিদের ‘ইন্ডিয়া’ উপনিবেশ থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখতে পেরেছিল, পেরেছিল নিজেদের বহু-শতাব্দীর রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র। মনিপুরীদের নিজভুমে বাইরের কে প্রবেশ করবে-না করবে, এটা ঠিক করার প্রায় নিরঙ্কুশ অধিকার-ও ছিল মনিপুরি-দের। ফলে মনিপুরের জন-গোষ্ঠীগুলোর ক্ষমতাগত ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্বগুলিও মুছে যায়নি। কিন্তু ১৯৪৯-এ ইন্ডিয়া-তে জুড়ে যাওয়ার ফলে, মণিপুরীদের এই বাইরের লোকের ঢোকাকে নিয়ন্ত্রণ করার স্বাধিকার আর রইলো না। তাই এই আই.এল.পি প্রবর্তনের দাবীর মূলে আছে মনিপুরের নিজস্ব জনগষ্ঠিগুলির নিজেদের পারম্পরিক আবাদভুমি তথা জন্মভূমিকে নিজেদের জন্য রক্ষা করার স্বাভাবিক বাসনা। তার কারণ, ইন্ডিয়ার মধ্যে বিলয়ের ফলে বাইরে থেকে আসা বিশাল সংখ্যক মানুষের ভিড়ে নিজভূমে পরবাসী হয়ে যাবার আশঙ্কাটা একদমই অমূলক নয়। উত্তর প্রদেশের জনসংখ্যা মণিপুরের থেকে ৭৫ গুণ বেশি। ইতিমধ্যেই ইম্ফল উপত্যকায় মণিপুরী ও বহিরাগতের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কাশ্মীর থেকে কন্যা-কুমারী, আমরা সকলে ভারতীয়, এই বহুল-প্রচারিত স্লোগানটা কি সত্যি নয়? আমরা সকলে এক জাতীয় হই বা না হই, যেটা একদম নিশ্চিত সেটা হলে যে আমরা সকলে একই রাষ্ট্রে সহ-নাগরিক। নতুন দিল্লীর কিশোর-যুব সমাজের যেমন নিরাপদ-ভাবে নির্ভয়ে জীবন কাটানোর স্বাধীনতা আছে,  মণিপুরী কিশোর-যুবসমাজের একই-রকম স্বাধীনতা নেই। কেন তাদের সে স্বাধীনতা নেই, তা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করলে ভারতীয় রাষ্ট্রের চরিত্র সম্বন্ধে কিছু অপ্রিয় সত্যপ্রকাশ অনিবার্য হয়ে উঠবে।  ওদিকে না যাওয়াই ভালো। পাঠকদের শুধু এটা লক্ষ্য করতে বলি যে দেখবেন ভারতের ‘জাতীয়’ মিডিয়া দিল্লীতে মনিপুরি যুবদের উপর হয়রানির ঘটনা নিয়ে যতটা প্রচার করে,আসল মনিপুরের মণিপুরী যুবসমাজদের জীবনের  দৈনিক ত্রাস ও লাঞ্চনাকে নিয়ে তার সিকিভাগ-ও করে না। করা সম্ভব না। দোকান বন্ধ হয়ে যাবে।

সাম্প্রতিক অতীতেও নিজভূম নিয়ে ব্যাপক অর্থে স্বতন্ত্র ছিল, এমন জাতি-গোষ্ঠীর পক্ষে হঠাত করে কোন বৃহত্তর ব্যবস্থার মধ্যে ‘ক্ষুদ্র’ স্থান পাওয়া বা নিজভূমে সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়াকে খুব সহজ-ভাবে নেওয়া সম্ভব না।  এমনটাই স্বাভাবিক। ভারত-রাষ্ট্রের মধ্যে নানা জাতীয়তার মধ্যে বহিরাগত জনস্রোতের ফলে নিজভূমে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার বাস্তব উদ্বেগ-কে ভারতের সংবিধান সাধারনতঃ কোন স্বীকৃতি দেয় না। কিন্তু তাই বলে উদ্বেগ-গুলি উবে যায় না, বিশেষতঃ যখন কাশ্মীর  থেকে কন্যাকুমারী অবধি বিস্তীর্ণ ভূখন্ডের বিভিন্ন এলাকায় মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থা, কাজের সুযোগ, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ইত্যাদি বিশাল তারতম্য আছে। অন্গামী জাফু ফিজো, প্রবাদ-প্রতিম নাগা জননেতা, ১৯৫১তে বৃহৎ জনসংখ্যার রাষ্ট্র ভারতের মধ্যে নাগাদের নিজস্ব আবাদ-ভূমির সন্ত্রস্ত অবস্থার প্রসঙ্গে বলেছিলেন ,’আমরা খুব সহজেই ডুবে যেতে পারি, হারিয়ে যেতে পারি : আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের সভ্যতা, আমাদের প্রতিষ্ঠান, আমাদের দেশ, এবং আমাদের সংগ্রামে আজ অবধি গড়ে তোলা যা যা আছে, সব ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তাতে মানবসমাজের সামান্যতম উপকার-ও হবে না’। কেউ নিজেদের পারম্পরিক আবাদভূমিতে প্রান্তিক হয়ে উঠতে চায় না। আজ বৃহৎ জাতীয়তার সামনে  ক্ষুদ্র জাতীয়তার ক্রমশঃ বিলীন হয়ে যাবার সংকটময় সময়ে  হয়তো কোথাও ফিজোর ঘোষণায় নিহিত বহুত্ববাদী ধারণা, অর্থাৎ সকল জাতীয়তার ও জাতি-গোষ্টির নিজ এলাকায় নিজেদের মত বাঁচার অধিকার নিয়ে আরো গভীরভাবে চিন্তা করার দরকার আছে। বাংলায় বা তামিলনাডুতে কি যথাক্রমে বাঙ্গালীরা বা তামিলরা সংখ্যালঘু হয়ে যাবার কথা কল্পনাতেও আনতে পারে? তা কি কখুনো মঙ্গলময় হতে পারে? এমন যদি কখুনো ঘটে, তার প্রতিক্রিয়ায় কি ধরনের শক্তির উন্মেষ ঘটবে, আমাদের কোন ধারণা আছে ? কোন জাতি-কে এমন ভাবে কোণঠাসা করা অনুচিত। তাই মণিপুরে আই.এল.পি দাবি এক ন্যায্য দাবী।

1 Comment

Filed under বাংলা, Delhi Durbar, Democracy, Foundational myths, India, Media

উবার চড়ে যাচ্ছি কোথায়?

খুব বেশিদিন আগের কথা বলছি না, কলকাতায় একটা সময় ছিল যখন গাড়ি চড়ে কোথাও যাবার মানে ছিল হয় প্রাইভেট গাড়ি বা টেক্সী। কিন্তু স্মার্টফোন ভিত্তিক আপ-এর দৌলতে ২৮ ঘন্টা  তত্ক্ষণিক ভাড়া গাড়ি বুকিং ব্যবস্থা ভারতের কিছু কিছু শহরের এক বিপুলভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। উবার বা ওলা গোছের কোম্পানিগুলি এখানে খুবই ভালো ব্যবসা করছে।  এছাড়া তাদের জোরদার বিজ্ঞাপনের ফলে তাদের নাম ছড়িয়েছে যথেষ্ট। আমাদের এই বাংলাদেশের পশ্চিমাংশে  তাদের এমনই রমরমা ব্যবসা যে উবার কোম্পানি জানিয়েছে যে মার্কিন কলকাতাই তাদের  বাড়তে থাকা বাজার এবং তাদের এই বৃদ্ধির হার তাদের লন্ডনের ব্যবসার চেয়েও বেশি। ভারতে  কলকাতার পরে তাদের সবচেয়ে দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকা বাজার হলো মুম্বইর। এই ধরনের পরিষেবা বিশ্বের অনেক জায়গাতেই চিরাচরিত লাইসেন্স প্রাপ্ত টেক্সী ব্যবসার লাভের গুড়ে থাবা বসিয়েছে। সেটা এখানকার ক্ষেত্রেও সত্যি। ফ্রান্স থেকে দক্ষিন আফ্রিকা, নানা জায়গায় ট্যাক্সি চালক তথা মালিক ইউনীয়ন্গুলি উবারের ব্যবসা পদ্ধতিকে অনৈতিক ও বে-আইনি বলে প্রতিবাদ জানিয়েছে – যে ধরনের সরকারী নজরদারির স্বীকার সাধারণ তেক্সীরা, বা যতরকমের কর তাদের দিতে হয়, তার ফলেই উবারদের সাথে তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। উদাহরণ স্বরূপ, টেক্সী না যেতে চাইলে আইনে জরিমানার ব্যবস্থা আছে, উবারদের ক্ষেত্রে এমন কোন আইন-ই নেই। সাধারণ টেক্সীগুলি বেসরকারী মালিকানাধীন হলেও সে ব্যবসা বেশ ভালো পরিমানে সরকারী নিয়ন্ত্রনের আওতায়।  টেক্সী ভাড়ার তালিকাও সরকারের সাথে বোঝাপড়া করে ঠিক হয়। উবার-ওলারা তাদের রেট্ ঠিক করে ও বদলে নিজেদের ব্যবসা মাফিক, নানারকম ছাড় ও অন্যান্য বিপণন-ফন্দিরও তারা সাহায্য নিয়ে থাকে, যা সাধারণ টেক্সী আইনত পারে না।

এই ভাবে যখন কোথাও এক ধরনের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য বেসরকারী পরিবহণ ব্যবসার একটা রেকর্ড প্রসার ঘটে, তখন সেই জায়গার গণ-পরিবহণের অবস্থা ও মান সম্পর্কে প্রশ্ন মনে চলেই আসে। তাই ভারতের প্রধান শহরগুলির গণপরিবহনের মান বিশ্বের নিরিখে দেখে নেওয়া যাক। ‘ফিউচার অফ আর্বান মোটিলিটি ২.০’ নামের বিশদ একটি জরিপ-ভিত্তিক গবেষণার ফল সম্প্রতি প্রকাশিত হয়। এই জরিপ রিপোর্ট-টি প্রনিধানযোগ্য কারণ এতে বাজার-আদর্শ ও শ্বেতাঙ্গ-বিশ্ব ‘প্রগতি’ ও ‘উন্নয়ন’ বলতে যা বোঝায় (মূলতঃ চওড়া রাস্তা ধরে হুস-হুস করে যাওয়া রাশি রাশি সমাজ-বিছিন্ন প্রাইভেট গাড়ি) , তার কিছুটা বাইরে গিয়েও গণপরিবহনের মানের একটা মানাঙ্ক কষা হয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টরকে মাথায় রেখে। এই সব ফ্যাক্টরের কয়েকটি হলো – মোট যাত্রা-সংখ্যার মধ্যে গণপরিবহনের সাহায্যে করা যাত্রার হিস্যা, স্মার্ট কার্ডের ব্যবহার, রাস্তার ঘনত্ব, গণপরিবহনের বৈচিত্র এবং সেগুলি কত সময় অন্তর অন্তর আসে, সরকারী পরিবহণ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নেওয়া উদ্যোগ, ইত্যাদি। সারা বিশ্বের ৮৪টি বৃহৎ শহরে এই নিয়ে গবেষণা ও জরিপ চালানো হয়।  তার থেকে পাওয়া ফলগুলি এইরকম। ভারতে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী মুম্বই-এর হাল মার্কিন রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি-র চেয়ে সামান্য ভালো, লস এঞ্জেলেস পিছিয়ে আছে চেন্নাই-এর থেকে। অনেকের ধারনায় ভারতে ‘উন্নত’ দিল্লির হাল এই বহুমাত্রিক গণমুখী ফ্যাক্টরগুলির নিরিখে বেশ খারাপ – সেটির স্থান ৮৪টি শহরের মধ্যে শেষের দিক থেকে ৫ম। কলকাতা হলো ভারতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ – ৮৪র মধ্যে তার স্থান ৩১, যার মানে আমরা নিউ ইয়র্ক, মন্ট্রিয়ল, টরন্টো ও সিডনির থেকে এগিয়ে আছি। জনসংখ্যার অনুপাতে ব্যক্তিগত গাড়ি মালিকানার হার ভারতের মেট্রো শহরগুলির মধ্যে কলকাতায় সবচেয়ে কম। পয়লা স্থান অধিকার করে হংকং। প্রসঙ্গত এই পরিমাপে ঢাকার রেঙ্ক করাচীর থেকে খারাপ কিন্তু বেঙ্গালুরু বা ওসাকা বা মায়ামির থেকে ভালো। এই রেঙ্কগুলি আমাদের যদি অবিশ্বাস্য লাগে, তার থেকে এই বোঝা যায় যে দুনিয়ায় উন্নয়ন ও প্রগতির জনবিরোধী হেজিমনিক ধারণা আমাদের কল্পনা ও ইপ্সাকে কতটা গুলিয়ে দিয়েছে যার ফলে আমরা সামনে ঘটমান বাস্তবকে দেখেও দেখি না, হাঁ করে অন্যত্র তাকাই। মাথার মধ্যে ভালো-খারাপ-গণমুখী-জনবিরোধী এইসব ব্যাপারগুলি কেমন গুলিয়ে মিলিয়ে দিয়েছে বাজার ও ক্ষমতার যুগলবন্দীতে তৈরী আমাদের এই ‘কমনসেন্স’। আর কলকাতা ও মুম্বই-এর তুলনামূলক ভালো স্থানের কারণে এরই রহস্যময় ও বেমানান লাগে সেই প্রাথমিক তথ্যটি – যে ভারতে উবার যে ধরনের  ব্যক্তিগত পরিবহণ ব্যবসা করে খায়, তাতে তারা সবচেয়ে সফল ঠিক এই কলকাতা ও মুম্বই-তেই।  আসলে ঘটছে তা কি? আমার কিছু আন্দাজ আছে।  আর সেই আন্দাজের হাত ধরে মনে আসে কিছু আশঙ্কা।

ভারতের শহরগুলির প্রায় সবকটিই অতি বিভক্ত শহর – বিভক্ত শ্রেণী, জাত ও অন্যান্য নানা ফেক্টর দ্বারা। আমরা এলিট বলতে বুঝি টাটা-বিড়লা।  আর বাকি সকলেই নিজেদের মনে করে মধ্যবিত্ত – অথচ এই মধ্যবিত্ত প্রায় কিছুতেই কোন কিছুর মধ্যস্থান অধিকার করে না – অর্থ-সামাজিক ভাবে তো নয়-ই। এই উপমহাদেশে এই গোষ্ঠিকে তুলনামূলক-ভাবে কম এলিট বলা যেতে পারে, কিন্তু এলিট তারা বটেই।  এই গোষ্ঠির নিজের গাড়িতে চেপে সবসময় সবজায়গায় যাবার সামর্থ্য নেই, যার ফলে তাদের অনেক ক্ষেত্রেই না চাইলেও অগত্যা গণ-পরিবহণের শরণাপন্ন হতে হয়। তাদের জীবনের এই অংশটি তাদের খরুচে ‘ট্রেন্ডি’ জীবনযাত্রার সাথে খাপ খায় না। গণপরিবহনে তাদেরকে এমন সমস্ত মানুষজনের পাশে বসতে হয়, এমন সমস্ত মানুষের গায়ের গন্ধ ঘামের গন্ধ নাকে আসে, ভিড়ের মান্ঝে এমন মানুষের থেকে ঠেলা ও গুঁতো খেতে হয়, নিজে দাঁড়ানো অবস্থায় এমন সব মানুষকে বসা অবস্থায় দেখতে হয়, যাদের কিনা তারা তাদের জীবনের অন্য সকল অঙ্গন থেকে নির্বাসিত করেছে সফলভাবে – নানা ধরনের প্রকাশ্য বা ছদ্ম ভৃত্য ভূমিকা ছাড়া। উবার-ওলার সাফল্যকে এই আঙ্গিকে দেখা প্রয়োজন। প্রথমতঃ।এর ফলে ‘পাবলিক’ থেকে নিজেকে স্থানিক-ভাবে আলাদা করা যায় – অর্থাৎ একই জায়গায় বসে যাতাওয়াত করতে হয় না, একই যানের মধ্যে বসে। দ্বিতীয়তঃ, পাবলিকের থেকে কালিক ভাবেই আলাদা হওয়া যায় – তাদের ২৪ ঘন্টা তত্পর পরিষেবার কারণে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ যে সময় গনপ্রবহনের অপ্রতুলতার জন্য বেশি ঘোরাফেরা করতে পারে না, যেমন ধরা যাক গভীর রাত, এই শ্রেণী সেই সময়গুলিকে কেন্দ্র করে নিজেদের জীবনধারা সাজিয়ে নেয়। সমাজের কিছু পাত্র-পাত্রীর মধ্যে জনসাধারণের থেকে নিজেদের আলাদা করে স্থান-কালের মালিকানা নেবার যে মানসিক ইপ্সা, উবার-ওলারা সেই বৈকল্যের ইচ্ছা-নদীতে সাঁকোর কাজ করে।  তার উপর দিয়ে আমাদের মত কিছু মনুষ তরতরিয়ে চলে যায় ইপ্সিত ওপারে, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, সুরক্ষিত ভাবে। বৈষ্ণবঘাটা-পাটুলি থেকে লেটনাইট পার্টি করে হিন্দুস্থান পার্কে ফেরত আশা হয়ে যায় জলভাত। শহরেরএলিটদের  জীবনে কিছু নতুন স্রোতের জন্ম হয়। কে কোথায় কখন কি ভাবে আসছে-যাচ্ছে, তাতে কারোর কিছু এসে যেত না, যদি না এই অর্থ-সমাজিক গোষ্টির প্রভাব ও প্রতিপত্তি তাদের সংখ্যার তুলনায় দৃষ্টিকটু ভাবে অনেক বেশি না হতো। কিন্তু বাস্তবে, তাদের উদ্বেগকে পাত্তা দেওয়া, তাদের সুরক্ষাকে সিরিয়াসলি নেওয়া, তাদের ইছাগুলিকে প্রশমিত করা হয়ে ওঠে  নগরের সরকারী ও বেসরকারী অধিপতিদের প্রথম কর্তব্য – কারণ যে মাছের মুড়ো এরা. তারই পেটি হলো উবার-ওলা শ্রেণী।  সংবাদমাধ্যমের বড় অংশও এই ক্ষুদ্র অংশের উদ্বেগ-সুরক্ষা ইত্যাদিকে এমন ভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে একটা ‘গণ’ চরিত্র দেবার চেষ্টা করে যে মনে হতেই পারে যে আমরা ইতিমধ্যেই একটি আর্থ-সামাজিক বৈষম্যহীন মিডিল ইনকাম সমাজে পরিণত হয়েছি।

এর একটি কুফল দেখা গেছে সম্প্রতি।  যখন ভারতে রাস্তা-ঘাটে নারী নিরাপত্তার মত একটি গুরুত্তপূর্ণ বিষয় নিয়ে বেশ একটা জনমত তৈরী তৈরী হচ্ছিল, উবারের একজন চালক দ্বারা এক মহিলা যাত্রীর ধর্ষিত হবার ফলে নারী নিরাপত্তা সংক্রান্ত পুরো বিষয়টি এই প্রতাপশালী গোষ্টির উদ্বেগের জোরে পর্যবসিত হলো উবার গাড়ির নিষিদ্ধকরণ ও উবার চালকদের নিয়োগের আগে পূর্ব অপরাধ বিষয়ক খোজখবর নেওয়া গুরুত্ব ইত্যাদিতে। ভারতে, নারীদের এক বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের কাছে  ভাড়া করা বা নিজ মালিকানাধীন গাড়িতে একা চলাফেরার সুবিধে-বিপদ সংক্রান্ত যে আলোচনা, তা একদমই অপ্রাসঙ্গিক কারণে তাদের জীবনের বাস্তবতার সাথে এর কোন সম্পর্কই নেই। অথচ ‘নারী নিরাপত্তার’ মোড়কে মিডিয়ায়ে আদতে চলল এলিট নারীদের নিরাপত্তার পুঙ্খানুপুন্ক্ষ আলোচনা।

যখনই সমাজের ক্ষমতাধারী ও গনপরিসরে-কি-আলোচিত-হবে-তা-নির্ণয়কারী গোষ্ঠীগুলি সর্বসাধারণের জন্য তৈরী পরিষেবাগুলি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়, তখন সেই সেই পরিষেবার মান নিম্নগামী হয়। কারণ পরিষেবাগুলি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিলেও সেই পরিসেবা চালনা সংক্রান্ত সকল ক্ষমতা এই গোষ্ঠীই কুক্ষিগত করে রাখে। তখন এদের নির্দেশে-উপদেশে সরকার যা করে তা হলো অপেক্ষাকৃত গণতান্ত্রিক ভাবে বন্টিত গণপরিষেবা থেকে অর্থ শুষে বার করে তারা ঢুকিয়ে দেয় এমন সব পরিষেবায় যা আপাত ভাবে সর্বসাধারণের জন্যে হলেও বাস্তবে কাজে লাগে মূলতঃ এলিট শ্রেনীর-ই। পূর্ব্বে উন্নত মানের এবং নির্ভরযোগ্য সংস্থা যেমন বৃহৎ সরকারী হাসপাতাল বা সরকারী ইস্কুল এই গোত্রে পড়ে। এলিট শ্রেণী এক-কালে এসব জায়গায় যেতো।  তারপর যখন তারা সরকারী ভর্তুকি ব্যবহার করে নিয়ম বদলিয়ে বেসরকারী পুঁজি দিয়ে এসব ক্ষেত্রে নিজেদের বিকল্প ব্যবস্থা করলো, তখন সরকারী সংস্থাগুলিতে তাদের আর কোন আগ্রহ রইলো না।  যে সর্বসাধারণের গরুর দুধ তারা রোজ খেতো এবং সেই কারণে বিচালি দিত, পরিষ্কার করত, সেই গরুর দুধ বেচে তারা তৈরী করলো নিজেদের মালিকিনাধীন গরুর  প্রাইভেট গোয়াল। কলকাতায়, টিবি হাসপাতাল ১ টাকা দিয়ে বেসরকারী সংস্থাকে বেছে তৈরী হলো কেপিসি হাসপাতাল।  ঢাকুরিয়ার এএমআরআই হাসপাতাল ও সরকারী মালিকানা থেক বেসরকারী মালিকানায় দেওয়া হলে ১ টাকার নাম-কে-ওয়াস্তে অঙ্কের বিনিময়ে।  শর্ত থাল এখানে একটা বড় শতাংশ বেদ থাকবে গরিবের জন্য সংরক্ষিত।  বলাই বাহুল্য, সেই সংরক্ষণ থেকে গেছে কাগজের পাতায়, এগ্রিমেন্টের দলিলে। আমি যেটা বলতে চাই সেটা এই যে ভারতে সরকারী হাসপাতাল বা ইস্কুলের মানের নিম্নগামী মানের সাথে এলিট শ্রেণীর স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে নিজ বিকল্প করে তলার ব্যাপারটি অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। দুটো আলাদা ঘটনা নয়। তাই আশঙ্কা হয়, হারত সরকারের জোরদার প্রাইভেট গাড়ি তৈরী ও বিক্রির ক্ষেত্রে নানা রকম আর্থিক উত্সাহপ্রদানের যুগে উবার-ওলার বিস্ময়কর ব্যবসায়িক সাফল্য দেশের মোটামুটি ভাবে চলনসই গণপরিবহন ব্যবস্থার জন্য কোন অশনি সংকেত বয়ে আনবে ? আরেকটু ব্যাপক ভাবে বলতে হলে, যে দেশ ও সমাজের শক্তিশালী নীতিনির্ধারক অংশ ব্যাপক গণ-মানুষের কোনরকম ছোয়া থেকে নিয়েজদের দূরে রাখতে চায়, এমন বৈসম্যযুক্ত সমাজপতি-ওয়ালা সমাজের ভবিষ্যত কি?

Leave a comment

Filed under বাংলা, Bengal, Democracy, Dhaka, Elite, Kolkata, Urbanity

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উত্কর্ষ – পিছিয়ে থাকা নিয়ে কিছু ভাবনা

প্রতি বছর বিশ্বের কিছু নামী সংস্থা দুনিয়ার সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিশাল রেঙ্কিং তালিকা এনে উপস্থিত করেন। কোন বছরেই কোন তালিকাতেই সেখানে ভারতীয় সংঘরাষ্ট্রের কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম ২০০-র মধ্যে আসে না। সেই নিয়ে এখানকার কিছু লোক একটু চিন্তা ব্যক্ত করেন। আর কেউ কেউ বলেন ওসব রেঙ্কিং আসলে পশ্চিমা দুনিয়ার চক্রান্ত, যাতে কিনা আমাদেরকে জোর করে হারিয়ে দেওয়া হয় (তারা বেমালুম চেপে যান যে শ্রেষ্ঠ ২০০-র তালিকায় একাধিক এশীয় বিশ্ববিদ্যালয় থাকে, থাকে চীনের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়)। যেসব পন্ডিত মনে করেন যে সমগ্র বিশ্ব একমাত্র আমাদেরকে কোণঠাসা করার জন্য এই শ্রেষ্ঠত্বের তালিকা থেকে আমাদেরগুলিকে বাদ দ্যান, তাদের জানা উচিত, এই ধরণের বিশ্ব-ষড়যন্ত্র মার্কা ধারণা গভীর মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ। অনেক ক্ষেত্রে কিছু রাজনৈতিক ধারা বা ধর্মীয় ধারা এমন ভাবে নিজেদের সকল বিশ্বের ষড়যন্ত্রের স্বীকার বলে প্রচার চালায়। এই সব সেয়ানা কারবারীদের চেনা প্রয়োজন। এরা কেউ অসুস্থ নয় – ষড়যন্ত্রের শাঁক দিয়ে নিজেদের ভেতরের পচনের মাছ ঢাকার একটা নিষ্ফলা চেষ্টা করেন এরা। এর ফলে বন্গায়ে শিয়াল রাজা হয়ে অন্যান্য রদ্দি শেয়ালদের থেকে বাহবা পাওয়া যায়, কিন্তু বিশ্ব-দরবারের বেঞ্চিতে এক ইঞ্চি জায়গা-ও জোটে না।

এই ধরা যাক বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ৫০-টা  বিশ্ববিদ্যালয় – সেগুলির কিছু বৈশিষ্টের দিকে একটু মন দিয়ে দেখি। তারপর নিজেদের সাথে তুলনা করি। আপাতত টাইমস হায়ার এডুকেশন রেন্কিং মেনে চলি, যদিও কিউ.এস এবং এ.আর.ডাব্লু.ইউ, এই দুটিও যথেষ্ট খ্যাতনামা। আমাদের সঙ্গে সবচেয়ে বড় একটা তফাত হলো যে এই শ্রেষ্ঠতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্নাতক স্তরের কোর্সগুলো মূলতঃ হয় সেই দেশের প্রচলিত মাতৃভাষায়। এবং সেই দেশে ইস্কুল্গুলির, পাঠ্যবই-এর মধ্যেও মাতৃভাষার দাপট-ই বেশি – এটা কোরিয়ান, ম্যান্ডারিন চৈনিক, সুইডিশ, ইংরেজি, জাপানি, জার্মান, অর্থাত যে সব দেশের মাতৃভাষার দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শ্রেষ্ঠ ৫০-এর তালিকায় আছে, এই সকল ভাষার ক্ষেত্রেই সত্যি। আমাদের এই বাংলাদেশে তথা দিল্লি-তে অনেক পন্ডিত বলেন যে মাতৃভাষায় ব উচ্চ-শিক্ষা হলে সমাজ পিছিয়ে পড়বে। তথাকথিত এক আন্তর্জাতিক পরিসরের দোহাই দিয়ে বলা হয় এইসব। তথ্য থেকে এটা পরিষ্কার যে মাতৃভাষা-হীন উচ্চ-শিক্ষা দিয়ে ইংরেজি-ভাষা প্রচলিত দেশের জন্য প্রযুক্তি-ব্যবসার ঝাঁকা-মুটে  বা মূলতঃ শ্বেতাঙ্গ বাচ্চাদের আমদানি করা ‘বৈচিত্রময়’ অধ্যাপক হওয়া সম্ভব, কিন্তু নিজ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে মাতৃভাষাকে দুরে রেখে উত্কর্ষ তৈরী কঠিন। রাজনৈতিক নেতারা যতই ‘সেন্টার ও এক্সেলেন্স’ লেখা শ্বেতপাথর উদ্বোধন করে জনগণ-কে ধোঁকা দিন, এক্সেলেন্স-হীনতার এই ফাঁকি এইসব রেঙ্কিং তালিকায় ধরা পড়ে যায়। এছাড়াও এর ফলে মাতৃভাষায় শিক্ষিত ইস্কুলের গন্ডি পেরুনো যে শিক্ষার্থী-সমাজ, যারা কিনা ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাদেরকে অবহেলা করে, প্রান্তিক করে দিয়ে, হীনমন্যতায় ভুগিয়ে তাদের মেধা সম্পদ নষ্ট করা হয়। এই সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয় দেশ ও জাতি।  অবশ্যই এর পিছনে রয়েছে আমার মতো ইংরেজিতে পরা ভদ্রলোকের বাচ্চার কায়েমী স্বার্থ। এই মাতৃভাষায় শিক্ষিত সমাজকে প্রান্তিক করে রাখা নিয়ে রেঙ্কিং হলে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়-গুলি যে বিশ্বে প্রথম ৫০-টি স্থান অধিকার করবে, এ নিয়ে আমার সন্দেহ নেই। তবে নিজেদের কায়েমী স্বার্থকে কি করে সর্বসাধারণের স্বার্থ হিসেবে দেখিয়ে ক্ষমতা ও প্রাধান্য ধরে রাখতে হয়, তার ইন্টেলেকচুয়াল ট্রেনিং দিতে আমরা ওস্তাদ।  পশ্চিমবঙ্গে অধ্যাপকের চাকরি লোভনীয়। নানা দেশের অধ্যাপকের মাস মাইনের সঠিক তুলনা (অর্থাৎ সেই পরিমাণ অর্থের সেই দেশে ক্রয়ক্ষমতা – যাকে বলে পারচেসিং পাওয়ার) করলে দেখা যায় যে এদেশের অধ্যাপকেরা গড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানী, ফ্রান্স, জাপান প্রভৃতি দেশের অধ্যাপকদের থেকে বেশি ক্রয়ক্ষমতার অধিকারী। আমাদের পিছিয়ে থাকাটা টাকাকড়ির কারণে না।

কি কি দেখা হয়েছে এই সব রেন্কিং-এ ? রয়েছে গবেষনার খ্যাতি ও পরিমাণ, শিক্ষা-দানের খ্যাতি, তবে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে ‘সাইটেশন ইম্পেক্ট’-এ।  অর্থাৎ এই যে জনগণের টাকা নিয়ে বিদ্যাচর্চা ও গবেষণার আয়োজন, তাতে যা পয়দা হচ্ছে, তা কি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশ্বে অন্যদের নজরে আসছে, তারা কি সেগুলির কথা বলছেন, নিজেদের কাছে ব্যবহার করছেন ? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি মূলতঃ জ্ঞান দেবার জায়গা, নতুন জ্ঞান তৈরী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গৌণ। এর ফল খুব সহজ। আমরা এখুনো  হা-পিত্যেশ করে বসে থাকি সাহেব-মেম-রা নতুন কি বার করলো। যেহেতু নিজেদের উঠোনে হয়না সেসব কাজ, তাই আমদানি করা জ্ঞান সিলেবাস ভুক্ত করতেও হয়ে যায় বিরাট সময়ের ব্যবধান। আর এই কারণেই চলে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি-ছাটার সময়ে দেশে আশা স্বজাতীয় পরিযায়ী পাখি অধ্যাপকদের নিয়ে একটা আদেখলাপনা। সাফল্যের মাপকাঠি হয়ে ওঠে বিদেশে কে কত নাম করলো। ফলে গবেষনার বিষয়-গুলিও মূলতঃ হয়ে যায় বিদেশের সমাজের মাথাব্যথার উপশম করার
‘আন্তর্জাতিক’ প্রকল্পে হাথ লাগানো বা শ্বেতাঙ্গ পন্ডিতকুলের আভ্যন্তরীণ বিতর্কে নাক গলিয়ে জাতে ওঠার চেষ্টা। আমাদের দুর্ভাগ্য যে এদেশের
ব্যবস্থা ঠিক এই ধরনের আচরণ-কে পুরস্কৃত করে।

অথচ এহেন গুরুদের প্রশ্নবিদ্ধ করার সংস্কৃতিকেও এখানে বেশ জোর দিয়ে ধামাচাপা দেওয়া হয়।  যেখা চিত্ত হওয়ার কথা ভয়-শূন্য, সেখানে
সামন্ত্রতান্ত্রিক গুরুবাদের ঠেলায় তৈরী হয় ত্রাসের পরিবেশ। প্রশ্ন করতে নেই, নিলে স্যার রেগে যাবেন, তারপর স্যার তার ক্ষমতা-মতো ‘দেখে
নেবেন’, তখন কে বাঁচাবে ? জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা এমন এক জিনিস, যেখানে সব কিছুকে অনাবৃত করতে হয়।  যেখানে যুক্তির শানিত ব্যবহারে অধ্যাপক-কে কাছাখোলা করাটাই শ্রেয়, সেইসব ক্ষেত্রে গুরুর ঘরের সামনে মাথা নোয়ানোকে মনে করা হয় আদর্শ ব্যবহার। মেধার বিকাশের জন্য গুরু-ভজনা নয়, গুরু-মারা বিদ্যা আয়ত্ত করা প্রয়োজন।  এবং দরকার সেই ধরনের গুরু, যারা ছাত্রদের গুরু-মারা জ্ঞানচর্চা করতে উত্সাহিত বোধ করেন, ‘আমি জানি না’ -পরিষ্কারভাবে  এই বাক্যটি  ভাবে বলতে পারেন সকলের সামনে।  এক্সেলেন্স ফলে মানুষের মাঝে মুক্তচিন্তার অঙ্গনে, শিক্ষামন্ত্রীর বাণীতে  না, ফলকে না, অধ্যাপকের চেয়ারে রাখা তোয়ালের নিষ্ফলা ‘মর্যাদা’তেও না।

মতান্তর ও বিতর্ক হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। ক্ষমতার সান্নিধ্য মুক্ত-চিন্তার কাছে বিষময়। ঠিক সে কারণেই চিরকাল-ই প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্ত্বের সাথে মেধা ও উত্কর্ষের একটা সম্পর্ক থেকেছে আর ক্যাম্পাসে সরকারপন্থী ছড়ি ঘোরানোর রাজনীতি জন্ম দিয়েছে গতদিনের
প্রফেসর অনিল ও আজকের  প্রফেসর শঙ্কুদের। এই বাংলার অন্যতম ভালো বিশ্ববিদ্যালয় যাদবপুরে কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা-সভা করতে অনুমতি দেওয়া হয়না, উপাচার্যের টুকলি-করা গবেষণা-পত্র ধরা পড়েও চাকরি থেকে সে বরখাস্ত হয় না – সসম্মানে ফিরে যায়ে পুরনো আস্তানায় – আরেক ‘উত্কর্ষ’ কেন্দ্রে, নিরাপত্তার নাম করে ছাত্র-ছাত্রীদের উপর সিসিটিভি নজরদারী চালানো হয়। যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে চিন্তা ও আলোচনার বিষয়
কর্তৃপক্ষের অনুমতিসাপেক্ষ, অধ্যাপক-বেশী চোরেরা আসল অধ্যাপকদের দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে বসেন, খাঁকি জামাপরা পুরুষ সরকারী কর্মীরা
সুরক্ষার নামে যুবক-যুবতীরা বিশ্ববিদ্যালয় চত্তরে কখন-কোথায়-কি করছে, তা টিভি-তে দেখার মত অশ্লীল কাজে লিপ্ত থাকে, সে দেশের কোন
বিশ্ববিদ্যালয় যে বিশ্ব-বরেণ্য তালিকায় নেই, এতে এত আশ্চর্যের কি আছে। তবুও এর মধ্যেই যাদবপুরের নয়া উপাচার্য্য সুরঞ্জন দাস যাদবপুরে
সিসিটিভি-গুলি নামিয়ে নিতে নির্দেশ দিয়েছেন।  শুরুটি ভালো। কার তাতে কি, আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি।

Leave a comment

Filed under Academia, বাংলা, Bengal, Education, Knowledge, Kolkata, Language

ভারত ও ঢাকার মাঝখানে – অনিকেত প্রান্তর

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সাথে ভারতীয় সংঘ-রাষ্ট্রের নরেন্দ্র মোদীর চুক্তির ফলে নিরসন হলো ছিটমহল অধ্যায়, যদিও এর মধ্যেই অন্য রাষ্ট্র  বেছে নেওয়ায়ে সংখ্যালঘু ঘর ইতিমধ্যেই ঘর জ্বলেছে এক রাষ্ট্রে । অদ্ভূত জিনিস এই ধর্ম, রাষ্ট্র ও নাগরিকত্বের টানাপড়েন-গুলি।  আর এসব  এলোমেলো করে দেওয়া সেই অদ্ভূত শব্দটি – ‘জন্মভূমি’। বাংলাদেশের অন্তর্গত ‘ভারতীয়’ ছিটমহলে ‘ভারতীয়’ নাগরিক শিশু পাশের গ্রামে (অর্থাৎ বাংলাদেশে) গিয়ে শিখেছে যে তার প্রধানমন্ত্রী হলো শেখ হাসিনা। সর্বার্থেই ছিট-মহল গুলি প্রান্তিক, এমনকি রাষ্ট্রও তাদের থেকে আনুগত্য দাবি করে না। ভারতের নাগরিক নিজেকে ভারতীয় মনে করে কিনা, তেরঙ্গা দেখে সটান হয় কিনা, গান্ধী দেখে শ্রদ্ধা দেখানোর ভাব করে কিনা, ক্রিকেটে পাকিস্থান-ঘেন্না করে কিনা, ছিটমহলবাসীদের ক্ষেত্রে ভারতের তাও এসে যেত না। আজকালকার রাষ্ট্র-ভিত্তিক বিশ্ব-চরাচর-কল্পনার দিনে  দিনে এর চেয়ে হতোছেদা আর কি করে করা যেতে পারে। যাই হোক, আশা করা যায় যে এখান থেকে দুই দেশের বাচ্চারা ঠিক ঠিক পতাকা দেখে ঠিক ঠিক সটান হতে শিখবে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী, যিনি ঘুণাক্ষরেও সোসিয়াল মিডিয়া-তে হিন্দি ছাড়া কোন দেশী ভাষায় তার প্রজাদের বার্তা পাঠান না, এ হেন পাক্কা ভারতীয় জাতীয়তাবাদী পূর্ব্ববাংলা সফরকালে সস্তা চমক দিয়ে সেখানকার বাঙ্গালীর মন জয় করার জন্য টুইট করলেন বাংলায়। একজন পশ্চিম-বঙ্গবাসী হিসেবে এটা  কতটা অপমানজনক যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাঙ্গালী হিসেবে আমাদের সেটুকু স্বীকৃতিও দেয় না, যতটা কিনা পূর্ব্ব-বঙ্গবাসীদের দেয়। আকাশ খুব অন্ধকার।  আমরা একটু নিজেদের ভাঙ্গা সিঁড়দারাটার দিকে চেয়ে দেখি, একটু লজ্জা পাই, একটু ক্ষুব্ধ হই, একটু আত্মসম্মান সঞ্চয় করি । স্বীকৃতি দিক না দিক, দিল্লি বাংলা ও অন্যান্য রাজ্যের থেকে করের টাকা নিয়ে খয়রাতি করে আসবে বিদেশে একটি বিশেষ ভাষা-কে ‘ভারতের  মুখ’হিসেবে ফোকাস দেওয়ার জন্য। এবার-ও নরেন্দ্রভাই-এর ঢাকা সফরকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে নতুন দিল্লির সরকার বাহাদুরের কল্যানে। বাঙালি, তামিল, অহমিয়া, তেলুগু, কন্নড়-ভাষী মানুষেরা এটা জেনে প্রীত হবেন যে তাদের ভাষা-সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব-টা হিন্দী আপনাদের না জানিয়েই নিয়ে নিয়েছেন আর সাথে নিয়েছে আপনাদের করের টাকা।  বলাই-বাহূল্য, নতুন দিল্লীর খয়রাতি পাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগটির নাম হিন্দী। আর এই সব খয়রাতি করে অনেকে ভেবেছেন ওরা হেব্বি খুশি।  ওরা কিন্তু অনেকেই বেশ রেগে আছেন।

কলকাতার হো চি মিন সরনীর নাম অনেকেই শুনে থাকবেন।  কেউ কেউ হয়তো জানবেন যে এই রাস্তার আগের নাম ছিল হ্যারিংটন স্ট্রীট। কে এই হ্যারিংটন? ইনি ফিরিঙ্গি কোম্পানির আমলে নিজামত বা সদর আদালত-এর প্রধান বিচারক ছিলেন।  ১৮২৩ সালের  ২৮ জুন তিনি লিখিত মন্তব্য করেন যে সতীদাহ প্রথা যদি তখুনি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলেও এই নিষিদ্ধকরণের বিরুধ্যে তেমন কোন রাজনৈতিক আন্দোলন তিনি আশা করেন না। অর্থাৎ জনগণ সে অর্থে সতিদাহর পক্ষে ছিল না। সতী-দাহ প্রথা নিষিদ্ধ হয় এর ছয় বছর পরে, ১৮২৯ -এ। নানা বিরুদ্ধতা উপেক্ষা সত্তেও সতিদাহ নিষিদ্ধকরণের যে প্রকাশ্য নায়কদের কথা আমাদের চিরকাল জেনে এসেছি, কিন্তু নেপথ্য নায়ক যে জনগণ, তাদেরকে স্বীকার করে নেন হ্যারিংটন। ফলে নায়কদের উচ্চতা একটু কমে, তাদের সংগ্রাম একটু ফ্যাকাশে হয়। তবুও সেটাই বাস্তব।  হ্যারিংটন-এর নামের জায়গায় হো চি মিন  দিয়ে সেটা ভোলা যায় না।  তবে হো চি মিন নামকরণের ছিল আরেকটি উদ্দেশ্য, এবং সেটি কিন্তু গর্ব করার মতো। এই রাস্তাতেই মার্কিন কনসুলেট। ভিয়েতনাম-এ মহিলা-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে মানুষকে হত্যা করার যে নৃশংস খেলায় মেতেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এটা ছিল তার-ই বিরুধ্যে কলকাতার নিজের মত করে প্রতিবাদ। একটু লজ্জা দেওয়া, একটু বিড়ম্বনায় ফেলা। কলকাতার মার্কিন দূতাবাসকে আজ-ও হো চি মিন-এর নাম স্মরণ করতে হয়, না চাইলেও। নৃশংসতার প্রতিবাদ হিসেবে লজ্জা দেওয়ার মতো নাম পরিবর্তনের দাবি কিন্তু বেশ ছোয়াঁচে।  নিষ্পাপ শিশু ফেলানি-কে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বি-এস-এফ বাহিনী গুলি করে হত্যা করে দুই বাংলার সীমান্তে। গরীবের মেয়ে ফেলানির দেহ লটকে সীমান্তের কাঁটাতারে লটকে থাকে বেশ কিছু সময়। আর বিঁধে থাকে ‘অনুভূতিগুলো’। এই কাঁটা-তার-এ ঝুলে থাকা শিশুর ছবিটি ভারতের ‘স্বাধীন’ ও ‘মুক্ত’ সংবাদ-মাধ্যম খুব বেশি প্রচার না করলেও, সারা বিশ্ব জেনে গেছিল ফেলানিকে এবং তাকে খুন করা উর্ধি-ধারী বাহিনীকে, যাদের মাইনে  আমি আপনি দিই। বাঙ্গালীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ঢাকায় উঠেছিল প্রতিবাদের ঝড়, দাবি উঠেছিল সেখানকার ভারতীয় দুতাবাসের সামনের রাস্তার নাম বদলে  ফেলানির নামে করে দেবার জন্য। তারপর যা হবার, তাই হয়েছে।  গরিব মানুষের মেয়ের মৃত্যু নিয়ে প্রতিবাদ বেশিদিন টিকে থাকে না – ঘটনা হয়ে যায় সংখ্যা । ফেলানি ঝুলে ছিল যে কাঁটা-তারে, দুই বাংলার মধ্যে সে কাঁটা-তার বানিয়েছে দিল্লী। এতে ওপার থেকে অনুপ্রবেশ কমেছে কিনা, তার কোন খবর নেই , তবে এই কাঁটা-তার লাগানোর বরাত পেয়ে যে ঠিকাদার-রা কাজ করেছেন, তারা যাদের ঠিকাদার হবার নিয়োগ দিয়েছেন, তাদের যে পকেট ভালই ভরেছে, সেটা বলাই বাহুল্য। সেটাও আমার আপনার টাকা। তবে এটা যেহেতু ‘জাতীয় সুরক্ষা’র প্রশ্ন, বেশি হিসেব চাইবেন না। বেশি হিসেব চাইলে আপনাকে সিধা করার মত নানা কালা কানুন ভারতে মজুত আছে – অশোক-স্তম্ভের সিংহ-গুলি শুধু দাঁড়িয়ে থাকে না, কামড়ে রক্ত-ও বার করে।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্প্রতি পূর্ব্ব বাংলা ঘুরে এসে বললেন যে ছিট-মহল বিনিময়ের ঘটনা হলো বার্লিনের প্রাচীরের পতনের মতই ‘ঐতিহাসিক’। এই ‘ঐতিহাসিক’ ধারণাটা আমি কখুনই ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। কোনটা ঐতিহাসিক, কোনটা নয়, কেই বা সেসব ঠিক করে দেয়।  তবে এটুকু জানি, যে দুই গরীব বাস্তুহারা টইটুম্বুর  বাংলার মধ্যে যে ‘অনিকেত প্রান্তর’, তার মাঝে কাঁটা-তার বসিয়ে আর যাই হোক, বার্লিনের প্রাচীর পতন হয় না। সীমান্ত-বাসী মানুষের ভাষা যারা বোঝে না, তাদের গায়ে উর্দি পরিয়ে, হাতে বন্দুক ধরিয়ে ধর্ষণ করানোকে, মন-মর্জি মতো মারামারি ও জিনিস-পত্র হাতানোকে, হতদরিদ্র মানুষ খুন করানোকে ‘সুরক্ষা’র নাম দেওয়া পাপ। এই পাপ কিন্তু আমাদের পয়সায় মাইনে পাওয়া-রা কিন্তু করে এপার বাংলার মানুষজনের সঙ্গেও।  এমন পাপ মা দূর্গা কখুনো মাফ করবেন কিনা জানিনা।

যখন এই দিল্লী-ঢাকা শীর্ষ দেওয়া-নেওয়া হচ্ছিল, পাশে থাকা থেকে সাথে থাকার সুললিত বাণী দেওয়া হচ্ছিল, ঠিক তখুনই হাসিনা সরকারের প্রবাস কল্যাণমন্ত্রী মোশারফ হোসেন ফরিদপুরে তার বহুদিনকার চেনা একটি প্রথিত্জসা সংখ্যালঘু পরিবারের বসতবাড়ি জোর করে হাতিয়ে নেবার সব রকম ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছেন। একদিন হয়তো সেই নিপীড়িত পরিবারের একজন ‘এপারে’ চলে আসবে। পশ্চিম-বঙ্গের বাঙ্গালীদের সংস্কৃতিক নিজস্বতাকে যারা স্বীকৃতি দেয় না, তাদের কোলেই খুঁজতে হবে নতুন আশ্রয় ও পরিচয়। তারপর তার এই নতুন প্রভু তার নিজের রাজনীতির খেলার অংশ হিসেবে দেখাবেন ‘নাগরিকত্বের’ লোভ। তাই দেখে পূর্ব্ব বাংলার কেউ কেউ বলবেন যে এমন ঘোষণা হলো অনধিকার-চর্চা। ঘর-পালানো মানুষটা কি আজ-ও ‘ওপারের’?  পূর্ব্ব বাংলার ভিটে ছেড়ে পালিয়ে আসা বাঙ্গালী হিন্দু ঠিক কোন মুহুর্তে ‘ইন্ডিয়ান’ হয়ে যায় এবং দেশ নিয়ে কিছু বলার অধিকার হারায়? পালানোর দিন ? বর্ডার পেরোলে ? ‘ইন্ডিয়ান’ নাগরিকত্ব পেলে? দুই পুরুষ পরে? নাকি এসবের অনেক আগে, ‘ভুল’ ধর্মে জন্মমুহুর্তে? আমি জানি না।

Leave a comment

Filed under Army / police, বাংলা, Bengal, Delhi Durbar, Dhaka, Foundational myths, Hindustan, Identity, India, Kolkata, Language, Partition, Religion

কুমিল্লা সংস্কৃতি উত্সব – স্পর্ধা অন্যতর

আমি যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌছলাম পড়াশুনো করতে, তখন ওখানে স্থিত পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালীদের মধ্যে অদ্ভূত আবিষ্কার করলাম। আপনি কোথাকার, এটা জিগেশ করলে, কেউ তার জেলা শহরের কথা বলেন না। প্রশ্নকর্তার ‘সুবিধার্থে’ বলেন যে তিনি কলকাতার।  কলকাতার একটা ব্যাপ্তি আছে।  ১৪৪ ওয়ার্ড-দিয়ে গড়া। আমি কলকাতা থেকে  বরানগরে  কর্মস্থলে যাই।  এটা কলকাতা নয়। কলকাতার উত্তরে একটা এলাকা। এখানকার অনেক মানুষ সহজ ভাবেই বলেন যে কাজে কলকাতায় যাচ্ছেন। আরেকটু উত্তরে ব্যারাকপুরে  কথাই নেই।  সেখানে এটা আরো পরিষ্কার ভাবে কলকাতা নয়, মানুষের ভাবনায়, চেতনায়, কল্পনায়। কিন্তু এই সব কিছু-কে কলকাতা মহানগরের মধ্যে মিলিয়ে দেবার প্রবণতার পিছনে আরেকটা কিছু রয়েছে। একটি শ্রেনীর হয়েছে, যারা কোনো কিছুরই নন গভীর-ভাবে।  তাদের ক্ষেত্রে স্থানীয় পরিচয় অপ্রাসঙ্গিক।  ‘গ্লোবাল’ দুনিয়ার ম্যাপে একটা খুঁটি পোতা  এবং অন্যদের কে বোঝানো – এটাই সেই আত্মপরিচিতির লক্ষ্য। এক সাথে রয়েছে স্থানীয় অনেক ব্যাপার থেকে এলিয়েনেশন। সেটা শ্রেণীগত কারণে হতে পারে, ‘গ্লোবাল’ সংস্কৃতির লেজুর-বৃত্তির ইপ্সায়  হতে পারে, স্থানীয় সংস্কৃতিক ধারা নিয়ে নিরক্ষরতাও একটা কারণ বটে। কিন্তু সকলে এমন নন। পূর্ব বাংলার যে মানুষদের সাথে আমার পরিচয়, তাদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভাবে স্থানীয় পরিচয় গৌণ  নয়, বা নিজেকে ‘ঢাকা’র বলে জানানোর প্রবৃত্তি কম।  এটা অনাবাসীদের ক্ষেত্রেও সত্যি। আমার বাড়ি চেতলা এলাকায়। আমি এখুন সেখানে থাকি।  পড়াশুনো ও গবেষনার কারণে ৮ বছরের প্রবাস জীবন কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছি। আমি অতি ভাগ্যবান যে এমন এক নিবিড় পারা-সংস্কৃতি, ধর্মাচার ও নানা রকম মানুষ ও বাজারের সাথে পরিচিত হতে পেরেছি বড় হবার সময়ে। যেহেতু আমি চেতলার, বাকি কলকাতা বা ‘কলকাতা’ কে দেখার আমার যে দৃষ্টি , যার মধ্যে চেতলার ছাপ অনস্বীকার্য।  আর সেটা হবে নাই বা কেন?  মাটি থেকে সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, হাওয়া থেকে নয়, এলিয়েনেটেড মানুষের আমদানি করা ভাঁজ থেকে না। স্বেচ্ছায় শিকড়হীন শ্রেণী যে পশ্চিম বঙ্গে ও কিছুটা পূর্ব বঙ্গেও রাজনীতিতে, ক্ষমতায়, সংস্কৃতিতে – অন্দরে ও বিশ্বের কাছে নিখিল বাংলাদেশের মানুষের ‘মুখপত্র’ হয়েছেন মূলতঃ শ্রেণীগত ভাবে এক ধরনের ইংরেজি ভাষায় সমাজকে স্থুল ভাবে সাহেবের কাছে ও একে অপরের কাছে প্রদর্শনের কারণে, এ আমাদের লজ্জা। দোষ তাদের না – দোষ বাকিদের, যারা এই জায়গা ছেড়ে দিয়েছে ভয়, স্পর্ধাহিনতায়। মাটির থেকে, স্থানজ সংস্কৃতি থেকে বিছিন্ন শ্রেনীর এই আধিপত্যের বিরুধ্যে লড়াই একটা গভীর লড়াই – এর সাথে আমাদের যুগের সংস্কৃতিক সংকট, ও তার সাথে ক্ষমতার সম্পর্কের প্রশ্ন অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। এই ‘আব্সেনটি ল্যান্ডলর্ড’ শ্রেনীর বিরুধ্যে সংগ্রাম কোন প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতিক প্রতিরোধ নয়। পশ্চিম-চালিত একমুখী বৈচিত্র-বিরোধী যে দানবের দুনিয়া জোড়া আস্ফালন আমাদের পোড়ার দেশগুলিতে, তার শিকড়হীন দেশীয় দালাল-দের বিরুধ্যে সংগ্রাম আসলে গণতন্ত্রিকরণের সংগ্রাম। এটাই এই যুগের গণ-লাইন। নানা বৈচিত্রের, নানা বিভন্গের মানব-জমিন কে দখলদার মুক্ত করা, যাতে কিনা ‘ডকুমেন্টেশন’ এর বাইরেও কিছু হয়, যাতে সে জমিতে নতুন ফসল ফোটে , যে জমিতে পূর্বসুরীরা ফসল ফলিয়েছেন – তার ধারাবাহিকতায় ও এবং সেই  স্থানীয় পরিপ্রেক্ষিতে তার থেকেই বিচ্ছিন্নতায় – যে বিছিনতায় রয়েছে, যার থেকে বিছিন্ন, তার গভীর ছাপ।

এই কথাগুলি বলার কারণ হলো আমাদের সংস্কৃতিক ভাবনা ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও, কলকাতা-ঢাকা কেন্দ্রিকতার ঝোঁক স্পষ্ট। কল্কে পাবার যে সংজ্ঞা গুলি, কোন উদ্যোগ হলে সেটি কোথায় হতে হবে, করা করা না দেখলে তা প্রায় দেখার মতোই হলো না – এই ধরনের প্রশ্ন নিয়ে বেশ কিছু কুসংস্কার কাজ করে। ‘গ্লোবাল’ সংস্কৃতি থেকেও তাহলে কিছু কিছু কুসংস্কারের উদ্ভব হয় – সব কিছু আমাদের স্থানজ যাপন ও চর্চার দোষ না। কি বলেন ?

অনেক কিছুই হয় কলকাতায়।  কিছুতে লোক আসে, কিছুতে আসে না।  অনেক ক্ষেত্রে অপাত্রে দান হয়। যদিও সে চর্চার মাহাত্ম্য বোঝার আসল লোক অন্যত্র।  কিন্তু সেখানে হলে মহানগরবাসী আদৌ যাবেন না।  অত দূর যাওয়া যায় নাকি। বাঁকুড়া – সে তো বহুদূর।  কিন্তু সে বাঁকুড়া থেকেই তারা আসেন, কলকাতার অত্যধিক ত্যালা মাথার তেল একটু গায়ে লাগানোর জন্য।  এই ধরনের সংস্কৃতিক কেন্দ্রিকতা সংস্কৃতিকে একটা নিষ্প্রাণ ধারণার সাথে ঠিক আছে, কিন্তু যাপন ও স্থানের পরিপ্রেক্ষিতে, এলাকার জল-আবহাওবায় ভেজে না সে সংস্কৃতি। তাই হয়তো তা  ‘এক্সপোর্ট কোয়ালিটি’র না। ডানা ছেঁটে, তাকে সাইজ করে, ‘ডকুমেন্ট’ করে, রামের জিনিস শ্যামকে দেখিয়ে,  সংগঠক হিসেবে নিজের নাম দিয়ে, এক শ্রেনীর ঠিকাদার নাম কামান সংস্কৃতির ধারক বাহক ও সমঝদার হিসেবে।  এদের শিকর-হীনতার জন্যেই, স্থানীয় ভ্যালুস এদের জীবনে অপ্রাসঙ্গিক হবার কারণে, এদের গর্জে ওঠেন ‘ঘষা-মজা’ না-করা স্থানীয় সংস্কৃতিক প্রকাশের বিরুধ্যে। কেন্দ্রিকতায় এদের কায়েমী স্বার্থ। ‘কস্মপলিটানিজম’ এর নাম এক বিশেষ ধরনের সংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ এদের মূল-মন্ত্র, যেখানে ল্যাজ-কাটা শেয়াল ল্যাজ-ওলা শেয়ালদের নিজ ল্যাজ সম্বন্ধে লজ্জিত করানোর চেষ্টা করে, ‘উচ্চমার্গ’ ও সূক্ষতার দোহাই দিয়ে। গণসংস্কৃতি, জনসংখ্যা -এদের বড় শত্রু। তাই সেগুলিকে জোর করে অদৃশ্য করে দেওয়ার চেষ্টা চলে নিরন্তর। তাই তো মনে হয় অনেকের কথা শুনে না ‘ইউথ’ মানে সে যে কফির পেয়ালা ধরে এক ধরনের চর্চা করে।  বাকি কিছুই ইউথ না। অন্ততঃ তাদের ইউথ হয়ে উঠতে অনেকগুলি ধাপ পেরোতে হবে, পরীক্ষা দিতে হবে শিকড়হীনতার – মাথায় তেলের চেয়ে সেম্পু বেশি লাগানোর।

এত কথা বললাম, কারণ ক্ষমতার সঙ্গে সন্ধি করে যে সংস্কৃতিক স্রোত বইছে মহানগরে, তার থেকে আলাদা যে কোন উদ্যোগ-ই বিরুদ্ধতা।  দহয়ত এটা দুঃখের যে স্বাভাবিক ভাবে বাঁকুড়া তে থেকে বাঁকুড়া নিমজ্জিত থাকাও আজকে একরকম দ্রোহ। এতেই ‘গ্লোবাল’ সংস্কৃতির অসহনশীলতার প্রকাশ। এরই মাঝে দাঁড়িয়ে আছে – এক, দুই, তিন নয় – ৫ বছরের কুমিল্লা সংস্কৃতিক উত্সব।

এই বাত্সরিক উত্সব কুমিল্লার মানুষের, অবারিত দ্বার সেখানে। সংগঠক এলাকার মানুষ, নতুন মানুষ এবং কুমিল্লার চশমা পরে বিশ্ব দেখে এসে ফের কুমিল্লায় আস্তানা বাঁধা মানুষজন – মনজুরুল আজিম পলাশ যার অন্যতম। এলাকার সংস্কৃতি, তার উপর যে নানা স্বার্থান্বেষী, বিদ্বেষী আঘাত – আধুনিকতার নাম, ধর্মের নাম – সে সকলের বিরুধ্যে দাঁড়িয়ে আছে এই উত্সব। ঢাকা, কলকাতা, চিটাগাং, টরন্টো, চীন এসকল জায়গা থেকে মানুষ কুমিল্লা গেছিলাম।  বড় শহর থেকে মানুষ ছোট শহরে যাবে কিছু পাবার জন্য – জজ-জুরি হিসেবে না, অতিথি হিসেবে, নিজেকে ব্যাপ্ত করার সুযোগ হিসেবে – এটা আজকের সময়ে বড় কম কথা নয়। এবং সেখানকার গণ-সংস্কৃতির কাছে মাথা নবাবে, আঁজলা  ভরে নেবে, হয়ত বা কিছু দেবেও।  এই ভাবেই অতিথির চোখে দেখলাম এই অসাধারণ উত্সব।  সুসু অতীত চর্চা নয়, শুধু ‘সনাতন’ চর্চা নয়, আবার সেসব বাদ দিয়েও নয়, আবার সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতা কে সামনে রেখে, অনেক স্বেচ্ছা-সেবকের উদ্যোগে হলো এই উত্সব।  এলাকার গণ-সংস্কৃতির ও গর্ববোধের কাঠামো যে মজবুত তা বুঝলাম কুমিল্লার একাধিক স্থানীয় দৈনিক কাগজ দেখে – এবং সেখানে এই উত্সবের উত্সাহী রিপোর্টিং দেখে।  আলাপ হলো কুম্মিলার কাগজের নির্ভিক দরদী সম্পাদক আবুল কাশেম হৃদয়ের সাথে।  আরো কত জানা হলো, কত কিছু শিখলাম।

এই সময়ে, এই স্পর্ধা করা যে কুমিল্লায়, তাদের কাছে যে মাল মজুত আছে, তা ঝুলি থেকে বার করে দেখালে, বাইরে থেকে লোক আসবে। তারাও আসবে নিজেদের একটু আধটু নিয়ে, নিয়ে যাবে অনেক বেশি।  আজকের কেন্দ্রিকতার দুনিয়ায়ে কুমিল্লা সংস্কৃতিক উত্সব ( কুমিল্লা কালচারাল ফেস্টিভেল) -এর স্পর্ধা অন্যতর বিশ্বায়নের এক মেনিফেস্টোর মত – গণসংযোগ, স্থানীয় সংস্কৃতিক স্বাক্ষরতা, মাটির সাথে সম্পর্ক, মানুষ সম্পর্কে শ্রদ্ধা, বিকেন্দ্রীকরণ, গণতন্ত্রীকরণ এবং নিজেকে পৃথিবীর কেন্দ্র মনে করা এক বহুকেন্দ্রিক পৃথিবীর কল্পনা করা।

গেছিলাম আমন্ত্রণে।  ফিরলাম এলাকাকে ও তার মানুষকে একটু চিনে, আর এও জেনে যে ঢাকা ও কলকাতার দিয়ে সংস্কৃতির সকল ধারা কে বাধ দেওয়া যায় না, এবং সেগুলি অনেক কিছুর জন্যই আদর্শ স্থান নয়।  আমার-ও কিছু পাওয়ার আছে কুমিল্লা থেকে। কাউন্টার ভ্যানগার্ড হয়ে হয়্তো তা ভ্যানগার্ড ধারণার সঙ্গে একটা সমালোচনা-মূলক সংলাপ। সেদিক থেকে কুমিল্লার এই উত্সব পথিকৃত। এলাকার গান ছিল, এলাকার নাটক ছিল, বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আশা মানুষের একাধিক মাস্টার ক্লাস ছিল, মোটর সাইকেল স্টান্ট ছিল, আলাপ-আড্ডা-হেঁটে বেড়ানো ছিল। পর্যালোচনা ও আত্মসমালোচনা ছিল।  স্থানীয় অশুভ শক্তির সাথে যুগপত সমঝোতা ও বিরুদ্ধতার যে কঠিন আভ্যন্তরীন সংগ্রাম, তাও ছিল।  শুধু অনুষ্ঠান সূচী দিয়ে এই উত্সব কে বোঝা যাবে না।  তার জন্য নিজ এলাকায় এমন উত্সব সংগঠিত করতে হবে, মানুষকে জুড়তে হবে।  কুমিল্লা সংস্কৃতিক উত্সব কোন তীর্থ না, এটি একটি মডেল। সতী মাতার শরীরের নানা অংশ বাংলার নানা স্থানে পড়েছিল , এক স্থানে পড়ে নি। তাই এত গুলি তীর্থ কে কেন্দ্র করা এতগুলি ধারা, এতগুলি চর্চা ও ভাবনা। পুরনো তীর্থ গুলু ধুঁকছে, নতুন তীর্থ জন্মাচ্ছে না,  ঢাকা-কলকাতা ‘মহাতীর্থ’ হয়ে উঠছে।  এই সময়ে দাঁড়িয়ে কুমিল্লা সংস্কৃতিক উত্সব একটি আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠার আভাস দেখায়। পরের বার ষষ্ঠ কুমিল্লা সংস্কৃতিক উত্সব।  চোখ কান খোলা রাখব আমি, আপনারাও রাখবেন। বিকল্প অন্বেষণের  একই প্রয়োগশালাটি  আবার দেখা সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়।

1 Comment

Filed under বাংলা, Bengal, Community, Culture, Dhaka, Kolkata

বোর্ড, শিক্ষা, আদর্শ – দিল্লী আমাদের ভবিষ্যত লুটছে

আমি যখন ডাক্তারী পড়তাম, একটা কথা বেশ চালু ছিল।এই যে পৃথিবীতে ডাক্তারদের বাজার কখুনোই কমবে না।  কারণ জনসংখ্যা বাড়তেই থাকবে, ফলে রোগীর সংখ্যাও বাড়তেই থাকবে। এই যুক্তিটি জন-সংখ্যার সাথে যুক্ত অনেক কিছুর ক্ষেত্রেই খাটে – যদি না ভয়ানক গোলমেলে কিছু ঘটে।  ঠিক তেমনই কিছু একটা ঘটছে আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা-ক্ষেত্রে। এবং আমরা উদাসীন।  একটু খুলে বলি।

শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা দিন কে দিন বাড়ছে, স্কুল পড়ুয়ার সংখ্যা বাড়ছে আর এসবের মধ্যেই এই বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমে গেছে ! ভাবা যায়? তাও সামান্য, নয় – নয় নয় করে প্রায় ১৫ হাজার। একই সাথে অবশ্য এ বাংলায় প্রতি বছর বেড়ে চলেছে দিল্লীর নানা বোর্ডের পরীক্ষার্থী সংখ্যা। পর্ষদ কর্তারা বেহায়া হয়ে অদ্ভূত সব কারণ দিচ্ছেন। কলকাতা শহরে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের পরিচালিত মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা এতই কমে গেছে যে নানা রকম অজুহাতের শাক দিয়ে পচে যাওয়া মাছ থেকে দুর্গন্ধ আটকানো যাচ্ছে না একেবারেই। এ কেমন করে হলো? এবং এমন চলতে থাকলে, ক্ষতি কি? ক্লাস টেন পাশ করাই তো মোদ্দা কথা – মাধ্যমিক হোক বা সিবিএসই /আইসিএসই। ব্যাপারটা এত সহজ নয়।

শিক্ষা নাগরিক গঠন করে। তাই একজন স্কুল-পড়ুয়াকে কি শেখানো হবে, সেটা গুরুত্তপূর্ণ। আমাদের বাংলাদেশের জাতি ও সমাজের ভবিষ্যত এই ‘কি শেখানো হবে’র আদর্শের উপ নির্ভরশীল। একেই বলে সিলেবাস। মাধ্যমিক ও দিল্লী থেকে আমদানি করা বোর্ড-গুলির সিলেবাস এক নয়। পার্থক্য আছে।  এই পার্থক্য মানের তারতম্যের প্রশ্ন না , ভিন্নতার প্রশ্ন। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে এতগুলি রাজ্য বোর্ড, তাদের সিলেবাসের ভিন্নতা আছে কারণ এই এলাকার মধ্যে বিশাল বৈচিত্র ও ভিন্নতা রয়েছে। তাই সিলেবাসকে যদি হতে হয় বাস্তবমুখী ও ছাত্রের আপন পরিবেশের সাথে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত, রাজ্য বোর্ড ছাড়া তার গতি নেই।  আর যদি ছাত্রটিকে তার পারিপার্শিকতা থেকে বিছিন্ন করে, তার বাঙালিত্বকে ছেঁটে দিল্লি-নির্দেশিত এক কল্পিত ভারতীয়ত্তর জোব্বা পড়ানোই হয় সিলেবাসের লক্ষ্য, তাহলে দিল্লির বোর্ড-গুলির জুড়ি মেলা ভার। যা শুরু হয়েছিল সৈন্য বাহিনী ও বদলির চাকরির লোকেদের সুবিদার্থে তথা মিশনারী কিছু প্রচেষ্টায়, সেই গোষ্ঠী-গুলির দ্বারা পরিচালিত বোর্ড-গুলি এখুন কেন্দ্রীয়-সরকারী নীতির মদতে এক-কালের শক্তিশালী ও খ্যাতিমান রাজ্য বোর্ড-গুলিকে পরিকল্পনা-মাফিক মুমূর্ষু করে তুলছে – শিক্ষার বানিজ্যিকরন তথা নাগরিকদের বৈচিত্র হরণের দ্বিমুখী উদ্দেশ্যে।  তার ফল ভয়ানক।

বাংলার বোর্ডে ইংরাজি, বাংলা বা হিন্দী মাধ্যমে পড়া ছাত্রটি জানতে পারে পশ্চিমবঙ্গের ভূগোলের খুঁটিনাটি বা বাংলার ধানের খেতে কি কি বোকা লাগে। তার ইতিহাস শিক্ষা স্রেফ দিল্লির  প্রাচীন ও বর্তমান সম্রাটদের গুনগাথায় সীমিত থাকে না। ভবিষ্যতে, জলে আর্সেনিক দুষণের প্রভাব দিল্লি থেকে আমদানি বোর্ড-গুলির সিলেবাসে না ঢুকলেও আমাদের ছেলে-মেয়েদের তা নিয়ে শিক্ষিত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। আমাদের এই বাংলাদেশের বৈশিষ্টগুলিকে বিশেষ-ভাবে অন্তর্ভুক্ত করা ইচ্ছা বা দায়, কোনটাই দিল্লীর নেই। ওদের থেকে আমদানি করা বোর্ড-এ  আপনার ছেলে-মেয়ে এই বাংলায় বসে ক্লাস-টেন পাশ করতে পারে এক বর্ণ বাংলা না শিখে। এই বঙ্গদেশের অধিকাংশ দিল্লী-বোর্ড-ওয়ালা ইস্কুলে প্রথম ভাষা হিসেবে বাংলা পড়ার কোন সুযোগ নেই। ভারতীয়ত্বের হাঁড়িকাঠে বাঙালিত্বের বলি দিয়ে যারা গুরগাঁও-বেঙ্গালুরুর দিকে শিশুকাল চেয়ে থাকবে চাতকের মতো, স্বপ্ন দেখবে হিন্দীর দেশের ইংরেজি মরুদ্যানে খেজুর গাছ হবার, আমরা কি সেই সন্তান গড়তে চাই? আত্মঘাতী হবার জন্য এর চেয়ে অনেক সহজ পথ আছে। 

এই বোর্ড-গুলি কার, এবং কাদের প্রাধান্য রক্ষা করতে গঠিত ও পরিচালিত, তা তামিল নাডু বা কর্ণাটকের অনেক শিক্ষাবিদের কাছেই পরিষ্কার।  শুধু এই অধম বাঙালি তার নিজের বোর্ড-এ পড়া ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত অন্ধকার করতে চায়, দিল্লির বোর্ড-গুলির সুবিধা করে দিয়ে।  কি ভাবে ? অনেক ভাবে।  একটা উদাহরণ এরকম।  অনেক  ছাত্র-ছাত্রীর স্বপ্ন পশ্চিমবঙ্গে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার।  তার জন্য দিতে হয় জয়েন্ট পরীক্ষা। তার সিলেবাস অধুনা বদলানো হয়েছে – যাতে কিনা পশ্চিমবঙ্গের বোর্ড ও দিল্লি থেকে আমদানি করা বোর্ড-গুলির সিলেবাসের মধ্যে যে অংশটুকু কমন, প্রশ্ন আসবে শুধু সেখান থেকেই।  অথচ, কেন্দ্র যে আইআইটি বা  অল ইন্ডিয়া প্রি-মেডিকেল পরীক্ষা নেয় , সেখানে কিন্তু কোন কমনের বালাই নেই – একদম সোজাসুজি দিল্লির বোর্ড-গুলির সিলেবাসকে অনুসরণ করা হয়।  অথচ, যেটুকু সুযোগ আমরা আমাদের ছাত্রদের দিতে পারি, সেখানে আমরা তাদের লেঙ্গি মারছি ‘কমন’ ‘কমন’ খেলায়।  আর বাংলার মেডিকেল কলেজগুলি থেকে যে ডাক্তার বেরুবে, যে কলেজগুলি বাংলার মানুষের টাকায় গড়া, তা কার  স্বার্থে? নিশ্চই কতিপয় কলকাতাবাসী ‘এস্পিরেসনাল’ যুবক-যুবতীর কেরিয়ার গর্তে নয়।  বরং তা বাংলার মানুষের স্বাস্থ্যের স্বার্থে।  আজ-ও বাংলার কনে কনে যে ডাক্তার , তারা অধিকাংশ সেই পশ্চিমবঙ্গ বোর্ড-এই পড়া  .গুরগাঁও-বেঙ্গালুরু-লন্ডনের স্বপ্নে বিভোর আধুনিক শহুরে ভারতীয় দিয়ে এই বাংলার স্বাস্থ্য পরিসেবা চলবে না, তার জন্য চাই সেই বাংলা বোর্ডের ছেলেমেয়েগুলিকে  – যারা জেলাগুলিকে চেনে, বাংলার গ্রাম-মফস্স্বল চেনে, এলাকার ভাষা জানে।  কোথায় আমরা তাদের আরো আরো সামনে আনব – তা না করে আমরা  ‘আধুনিকীকরণের’ নাম বাংলার নিজের বোর্ড-কে ধ্বংস করছি। এ সকলেই জানেন যে পশ্চিমবাংলায় দিল্লি থেকে আমদানি করা বোর্ডে পরা শিক্ষার্থীরা তুলনামূলকভাবে  বেশি  শহরকেন্দ্রিক, বেশি বিত্তশালী বর্ণহিন্দু প্রভাবিত। পাশ করলেই বাংলা ছেড়ে ফুরুত হবার স্বপ্নে বিভোর শ্রেনীর ত্যালা মাথায়ে তেল দিয়েই কি আমরা  সোনার বাংলা গড়ার চেষ্টা করছি ?  গুরগাঁও-এর কর্পোরেট হাসপাতালের ডাক্তার গড়ার কোন দায় পশ্চিম-বাংলার মানুষের নেই। বাংলা বোর্ডের সিলেবাস নির্ধারণকারী আধিকারিক যারা, জয়েন্ট এন্ট্রেন্স বর্ডার পদাধিকারী যারা, তাদের সন্তানেরা কোন বোর্ডে পড়েন, সেটা জানা দরকার। নইলে এসব ক্ষেত্রে  অন্য কি কি ধরনের স্বার্থ  কাজ করতে পারে, তা জানা যাবে না।  আমাদের বুঝতে হবে কাদের চক্রান্তে বাংলা বোর্ড ক্রমে পরিনত হচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেনীর বোর্ডে, যেখানে বনের জলে ভেসে আসার ঠাই পাবেন।

বাঁকুড়া জেলা স্কুল, বর্ধমানের সিএমএস। সিউরী জেলা স্কুল – এই নামজাদা প্রতিষ্ঠানগুলিকে জোর করে হারিয়ে দিলে শেষ নিরিখে বাংলা হারবে। দিল্লির নামধারী ইস্কুলে দিল্লি থেকে আমদানি সিলেবাস পড়ে শহুরে বাঙালির  বাচ্চারা মানুষ হবে – বাংলার ভবিষ্যত আর যেখানেই হোক, এই উড়ে এসে জুড়ে ব্যবসা করা ইস্কুল্গুলির অলিন্দে খোঁজা অনুচিত। ব্যাপারটিকে যেন আমরা  মাতৃভাষায় শিক্ষার সাথে গুলিয়ে না ফেলি।  পশ্চিমবঙ্গের মধ্যশিক্ষা প্রসদের অনুমোদিত স্কুলগুলির সিলেবাস বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে অভিন্ন।  আমি পড়েছিলাম সাউথ পয়েন্ট-এ , এক কালের নামজাদা ইস্কুল, পশ্চিমবঙ্গ বোর্ডের মুকুটের একসময়কার মণি।  এখান সময় পাল্টেছে – সেখানেও দিল্লি ও কেন্দ্র ঢুকেছে। শুনি ব্যবসা বেড়েছে। বেনিয়া কেন্দ্রীয়করণের এই প্রকল্পে, বাংলার মাজরা পোকা ও আলুর ধ্বসা রোগে নিয়ে শিক্ষার কোন জায়গা নেই।  তবুও কি আমরা আশা করতে পারি না, আমরা আমাদের বাংলার বোর্ড সেই ভাবে গড়ব , যাতে কিনা শহুরে বাঙ্গালী  ‘মিডিল-কেলাস’-এর গ্লোবাল ও ইন্ডিয়ান পোলাপানের সাথে মফস্স্বলের, গ্রামের, শহরের মধ্যে অন্যত্র শহরের সেইসব ছেলেমেয়েরাও সুযোগ পায় সাফল্যের – যাদের আজ দিল্লি ও তাদের বাঙালি দালালেরা জোর করে হারিয়ে দিচ্ছে।

2 Comments

Filed under Acedemia, বাংলা, Bengal, Class, Delhi Durbar, Education, Elite, Identity, Kolkata, Language

আমার শহর, আমার আশা

সামনেই আমার শহর কলকাতার পৌর নির্বাচন। এ শহর আমার জন্মের শহর। এখানে বস্তিবাসীকে নিমেষে হটিয়ে দিয়ে শহর ‘পরিষ্কার’ করা যায় না – কাউন্সিলর এম-এল-এর বেনামীতে প্রমোটারী ব্যবসা সত্ত্বেও। এখানে প্রধান প্রধান রাজপথে লক্ষ লক্ষ্য হকার সৎ ভাবে আয় করেন – মানুষের পেটে লাথি মেরে সূর্যোদয়ের বিরূদ্ধে দাঁড়ায় এ শহরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। এ শহরের পথে বিহারের দ্বারভাঙ্গা জেলার গরীব খাটিয়ে মানুষ বাংলা ভাষার জ্ঞান ছাড়াই ক্ষুন্নিবৃত্তি করে। অন্য কিছু শহর যেমন বাঙ্গালিকে হিন্দুস্তানি বা ইংরেজি বুলি বলতে বাধ্য করে, আমার শহর সেই পংক্তিতে পড়ে না। এ শহরের মন বড়। এ শহর আমার গর্বের শহর। তাই শহরের পৌরসভায় আমার প্রতিনিধিত্ব করবে কে, এটা খুব এলে-বেলে একটা সিদ্ধান্ত নয়। তেরঙ্গা পতাকার রাষ্ট্রর থেকে এই শহর আমার রোজকার জীবনে অনেক অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক, অনেক বেশি বাস্তব।

আমার এ শহর নিয়ে ক্ষোভ আছে – যেমন মানুষের থাকে একদম একান্ত নিজের কিছুকে নিয়ে। আমার ওয়ার্ডের পৌরপিতা আমাদের এলাকার নতুন কাজ বা পরিকল্পনা নিয়ে অরাজনৈতিক নাগরিক সভা করেন না। আমার এলাকায় আমার প্রতিনিধি যিনি, তার কাছ থেকে এইটুকু কি আশা করা খুব অন্যায়। আপনারা যারা এবারও আমার পৌর-প্রতিনিধি হবার ইচ্ছা রাখেন, এলাকার নানা পরিকল্পনা দলের রং না দেখে, নাগরিক-দের সাধারণ সভা ডেকে করবেন – এমন কথা দেবেন? এই টুকু চাইব না? অথচ আমার করের টাকাতেই তো পুরসভা চলে। বাড়ির বাচ্চাকে আলু-বেগুন কিনতে বাজারে পাঠালে আমরা পাই-পয়সার হিসেব নিই, আর কোটি কোটি টাকার বরাতে কর্পোরেশনের বাজার-রাস্তা-ইস্কুল-ত্রিফলার হিসেব নেব না ? হিসেব চাইব আমি নাগরিক হিসেবে। শহরের সৌন্দর্যায়নে আমার আপনার মতামত নেওয়ার দরকার নেই আমাদের প্রতিনিধিদের? নইলে সে কেমন প্রতিনিধি ? আমার আপনার ভোটে জিতে সে তাহলে কার প্রতিনিধিত্ব করে?

যে চরিত্রহীন, তার হীনমন্যতাই তাকে বাধ্য করে অন্যের চরিত্র ধার করে নিজেকে চরিত্রবান প্রমাণ করাতে। যার গায়ে কাপড় নেই, সে অন্যের জমকালো কাপড় গায় জড়িয়ে লজ্জা নিবারণ করে। যারা কলকাতাকে লন্ডন-নিউয়র্ক বানাতে চান, তারা না চেনেন কলকাতাকে, না চেনেন লন্ডন-নিউয়র্ককে। তাই তো তারা পরমা আইল্যান্ডের ‘পরমা’ স্থাপত্যকে ভেঙ্গে দেন অবলীলায়, বৃটেনের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রতিবাদ করে ইংল্যান্ড থেকে কলকাতায় এসে আস্তানা গড়া বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী ও সমাজচিন্তক জে বি এস হলডেনের নামাঙ্কিত রাস্তার নাম বদলের পায়তাড়া করা হয়। মধ্যমেধা ও মধ্যকল্পনার সাথে চাটুকারিতা ও দুনম্বরী মেশালে তিলোত্তমা গড়ার তিলের যোগান হয় না, লন্ডন-সিঙ্গাপুরের কয়েক তাল স্থুল অনুকরণ গড়া যায় ঠিকাদারী ব্যবসার মাধ্যমে। এ শহরের নিজস্বতা, এ শহরের প্রাণ-ভোমরা – শহর সাজাতে যদি তাকে যদি মন্থন না করা হয়, তখন সৌন্দর্য্য হয়ে ওঠে নগর ও নাগরিকের মধ্যেকার একটি দেওয়াল। সে দেওয়ালের উচ্চতা দেখে ভয় ও সমীহ হতে পারে, কিন্তু কেউ সেখানে গিয়ে চুমু খাবে না, আল্পনা দেবে না।

এ শহর দাঁড়ায় সিঙ্গুরের পাশে। তাই এ শহরে বিজনেস ক্লাসে উড়ে আসা লোক কম। আর খুব কম সম্বল করেও অমাবস্যার রাতে একটুখানি চাঁদের আলোর স্পর্শ পেতে চাওয়া লোকের সংখ্যা অনেক। আমার শহরের নায়কেরা শহরের নাম ভাঙিয়ে ক্রিকেট দল খোলে না , বিনোদন টেক্স বাকি রেখে নেচে কুদে ‘আই লাভ কলকাতা’ বলে বোম্বাই পালিয়ে যায় না। আমার শহরের আসল নায়কদের একজন হলো শমভু সিং। এ শহরের দক্ষিণে গগনচুম্বী বহুতলের খোপ-ঘরের আধুনিক হুল্লোড়ের উপর ঘুরপাক খায় জয় ইঞ্জিনিয়ারিং-এর নিহত কর্মী শমভু সিং-এর বিদেশী আত্মা – অপরাজিত সৈনিকের মতো। এহেন শহরের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব করা যে-সে কাজ না। এ শহর দিল্লি-বেঙ্গালুরু-নয়ডা-গুরগাঁও হতে চায় না। এ শহর এখুনো দোকানের নাম ও রাজনৈতিক পোস্টার লেখে মাতৃভাষায়। এ শহর হিন্দুস্তানের মরুভূমিতে মরুদ্যান নয়, ভাগীরথী-হুগলীর ব-দ্বীপের কোল ঘেঁসে গড়ে ওঠা মহা-গঞ্জ। এ শহর নিখিল বাংলাদেশের বৃহত্তম শহর। এ শহর অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের সকল বঙ্গবাসীর।

আমার শহরে থাবা বসিয়েছে অনেক দুর্বৃত্ত। তারা শহরের রাজপথে সাইকেল চালানোকে বে-আইনি ঘোষণা করেছে। তারা গাড়ি থামিয়ে মানুষকে সিগনাল পারাপার করতে একটু বেশি সময় চায় না। তাদের কাছে ট্রাফিক মানেই গাড়ি, রাস্তা মানে শুধুই গাড়ীর পথ। আমি চাই আমার পৌর-প্রতিনিধি এদের সমঝে দিক। আমি চাই আমার শহরে গাড়ি কমুক, বাস বাড়ুক, পথিক বাড়ুক। আমি চাই আমার আগামী প্রজন্ম সুস্থ থাকুক, ভালো ভাবে শহরে নিশ্বাস নিতে পারুক। যিনি আমার প্রতিনিধি হবেন, তার প্রতি আমার দাবি অনেক, আশা অনেক। তারা পারবেন-ও, যদি ইচ্ছা থাকে। আর যদি থাকে শহরের প্রতি ভালবাসা, শহরবাসীর প্রতি দরদ।

আমি চাই আমার ওয়ার্ডে আরো গাছ লাগানো হোক – ফলের, ফুলের। সবুজ রং দিয়ে শহর মুড়লে সবুজায়ন হয় না। নীল রং দিয়ে মুরলে নীলকন্ঠ হওয়া যায় না, পাপ পাপ-ই থেকে যায়। সাদা রং করে পবিত্র হওয়া যায় না – প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। লাল নিশান ওড়ালেই সংগ্রামী হওয়া যায় না – তাপসী মালিকের কাছে ক্ষমা চাইতে হয়। আসন্ন নির্বাচন পুরনো হিসেব বুঝে নেবার নির্বাচন, নতুন দাবি রাখার নির্বাচন।

আমার শহর দেশভাগের শহর। এ শহরে একাধিক বাজারের নাম বাস্তুহারা বাজার। এ শহরের অনেক হকার প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় প্রজন্মের রিফিউজি। এ শহর বিস্থাপিতের অভয়ারণ্য। এ শহর শুধুমাত্র মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তদের দিয়ে তৈরী ‘বস্তিহীন’ হকার-হীন ‘ছিম-ছাম’ ও ‘শান্তিপূর্ণ’ নকল শহর না। বাস্তুহারা বাজারের প্রতিনিধিত্ব বড়বাজারের দ্বারা সম্ভব না। ওসব এখানে হয় না।

Leave a comment

Filed under বাংলা, Bengal, Democracy, Kolkata, Urbanity

গোবিন্দ হালদারের নিষিদ্ধ ফিসফিস

সে যতই দেখনদারী হোক, সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর ওপার বাংলায় যাত্রার ফলে কিছু সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে – যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা ছাড়াই একটি জাতির দুই বিভক্ত অংশের একে অপরের দিকে নতুন করে তাকানো। এই বিভক্তির কারণের মধ্যে, তার ঠিক-ভুলের মধ্যে না গিয়েও একটা কথা বলা যায়। দেশভাগ ও তার পরেও ঘটতে থাকা খুন-ধর্ষণ-ধর্মান্তরকরণ-লুঠ-ঘরপোড়ানো-সম্পত্তিদখল ইত্যাদি ভয়ানকের অপরাধের শাস্তি হয়নি, এপারেও – ওপারেও। এই আদি পেপার বোঝা সুদে-আসলে এতই ভারী যে মানুষ সেই বোঝাকে ফেলে দিয়ে ভুলেই গেছে পাপের কথা। প্রায়শ্চিত্ত তো দূরস্থান।

১৯৪৭-এর বাংলা-ভাগের সাথে ব্রিটিশদের দ্বারা উপমহাদেশের শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলির হাতে যে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছিল, আজকের ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন, পাকিস্তান, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এক অর্থে তার-ই ফসল। এই ভাগের সাথে সাথেই ‘আমরা’ কারা ,’বন্ধু’ কারা ’, ‘শত্রু’ কারা- এগুলির নানা মিথ রচনার বীজ পোঁতা হয়, যার থেকে বেরোনো মহীরুহ আজকের দিনে আমাদের মনকে, আমাদের কল্পনাকে একদম আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে। নতুন রাষ্ট্রের পেটের গভীর থেকে জন্মানো এই কল্পকাহিনীগুলি যে আজ পবিত্র সত্যের স্থান নিয়েছে, তা শুধু গল্পের ভাবের জোরে নয়। সরকারী প্রচার এবং সরকারী বাহিনী, ঘুষ ও শাসানি, আঁচড় ও আদর, পুরস্কার ও থার্ড ডিগ্রী, জন্মবার্ষিকী উদযাপন ও মিথ্যা মামলায় হাজতবাসের এক অসামান্য সংমিশ্রনেই আজকের পবিত্রতা, সংহতি, ‘বিকাশ’, রাষ্ট্রপ্রেমের জন্ম (দেশপ্রেমের নয়)। সাবালক এই সব বিষবৃক্ষের রসালো ফলের আমার দৈনিক কাস্টমার। দেশভাগ পরবর্তী সময়ে, আমাদের স্বকীয় আত্মপরিচিতকে পিটিয়ে পিটিয়ে রাষ্ট্রীয় ছাঁচে ঢোকানো হয়েছে দিল্লী, ইসলামাবাদ ও ঢাকার মাতব্বরদের স্বার্থে। মানুষের আত্মাকে কেটে সাইজ করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ও রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার জুজু দেখিয়ে। এই পাপ বঙ্গোপসাগরের থেকেও গভীর।

আমাদের কল্পনা ও স্মৃতির অগভীরতার কারণে আমরা মনে করি যে এক রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য বোধয় দৈব নির্ধারিত কোন ‘প্রাকৃতিক’ নিয়ম যা না মানলে আমরা দুনম্বরী বিশ্বাসঘাতক মানুষ। যাদের আনুগত্য, টান ও ভালবাসা রাষ্ট্র-সীমান্ত পেরোলে ঝুপ করে উবে যায় না, তারা বুঝিবা মানসিক বিকারগ্রস্ত এবং রাষ্ট্রের চোখে নেমকহারাম। রোজ এই ধারণাগুলিকে বিনা বাক্যে মেনে দিয়ে আমরা আমাদের এই মর্ত্যলোকে স্বল্প সময়ের জীবনকে করে তুলি ঘৃণাময়, ভীতিময়, কুঁকড়ে থাকা। ১৯৭১-এ কিছু সময়ের জন্য পূর্ব বাংলার মুক্তিসংগ্রামের সময়ে এপার বাংলায় এরকম অনেক তথাকথিত বিকার চোরাগলি ছেড়ে রাজপথে মুখ দেখানোর সাহস ও সুযোগ পেয়েছিল। এ সত্যি যে ১৯৭১-এ ইন্ডিয়ান উনীয়নের নানা এলাকায় পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সমর্থন ও সাহায্য ছিল। কিন্তু পশ্চিম বাংলায় এই সাহায্যের আড়ালে যে আবেগের প্রকাশ ঘটেছিল, তা আজকের ডেটল-ধোয়া ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্রাষ্ট্রিক সম্পর্কের পবিত্র গণ্ডির বাইরের এক প্রায়-নিষিদ্ধ জিনিস। পশ্চিমবঙ্গের সাথে পূর্ববঙ্গের যে একাত্তুরে ‘ঘনিষ্টতা’, তার সাথে কর্ণাটকের সাথে পশ্চিমবঙ্গের ঘনিষ্টতা বা কর্ণাটকের সাথে পূর্ববঙ্গের ঘনিষ্টতার কোন মিল নেই। এই মিল-অমিলের অঙ্ক মেলাতেই তো ঘনঘন বেজে ওঠে জাতীয় সঙ্গীত, যাতে এরম চিন্তা গুলিয়ে যায় মিলিটারি ব্যান্ডের আওয়াজে। দিল্লি-ও একাত্তরে ভালই জানত এসব ‘নিষিদ্ধ’ প্রেমের কথা – কিন্তু এই প্রেম তখন তার রাষ্ট্রীয় স্বার্থের পক্ষে কাজ করেছিল বলে বাড়তে দিয়েছিল কিছুদিন অন্যদিকে তাকুয়ে, তারপর রাশ টেনে সমঝে দিয়েছিল সময়মত। এই আচরণেরও অন্য উদাহরণ আছে। যেমন তামিল নাদুর বিধানসভায় শ্রীলংকার ইলম তামিলদের সমর্থনে যেসব প্রস্তাব পাশ হয়, তা নিয়ে দিল্লীর নিস্তব্ধতা – যেন দেখেও দেখছে না। যেমন কাবুল ও পেশোওয়ারের মধ্যে যে ঠান্ডা-গরম পাখতুন বন্ধন ও তা নিয়ে আজকে ইসলামাবাদের চাপা ভীতি।

১৯৭১ অবশ্যই অতীত। সেই ‘নিষিদ্ধ’ প্রেম আমরা কবে বন্ধক দিয়েছি বেঙ্গালোর-দিল্লী-নয়ডা-গুরগাঁও স্বপ্নে বিভোর হয়ে। তাই তো আজ, আমরা, এই বাংলায়, দিল্লির থেকে ধার করা চশমায় পূব দিকে তাকাই আর দেখি – গরুপাচারকারীর মুখ, অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর মিছিল, হিন্দু বাঙালির শেষ আশ্রয়স্থল হোমল্যান্ডটিকেও জনসংখ্যার বিন্যাসে কেড়ে নেওয়ার দীর্ঘমেয়াদী ষড়যন্ত্র। এই সবই কিছু ঠিক, কিছু ভুল, কিন্তু সেসব ঠিক-ভুলের পরেও মধ্যে লুটোয় দিগন্তজোড়া বাংলাদেশের মাঠ, যে মাঠ শুধু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মাঠ নয়, বরং নিখিল বাংলাদেশের মাঠ। সে উত্তরাধিকার আজ প্রায় তামাদি।

বিগতকালের এই যে সম্পর্ক, যার শেষ প্রতিভুদের একজন এই গোবিন্দ হালদার। একরাষ্ট্রের আনুগত্যে বাঁধা আমরা, তাই এ প্রেমের কথা কেউ প্রকাশ্যে স্বীকার পায় না। এ সম্পর্ক – তা ঠিক পরকীয়া নয়, বরং এমন এক প্রেম যার শুরুর পরে প্রেমিক হয়েছে বিভাজিত। আর প্রেমিকার প্রেম থেকে গেছে একইরকম। কিন্ত অন্যের চোখে সে দুই প্রেমিকের প্রেমিকা, এবং কলঙ্কিনী। এমনই এক প্রেমিকা ছিলেন গোবিন্দ হালদার। গত ১৭ জানুয়ারী, ৮৪ বছর বয়সে মারা গেলেন অতি সাধারণ এক হাসপাতালে। অবিভক্ত যশোর জেলার বনগাঁ এলাকায় জন্ম।বনগাঁ ‘পড়ে’ ‘ইন্ডিয়ায়’।আকাশবাণীর জন্য গান লিখেছেন। একাত্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল আকাশবাণী কলকাতা। পরে যুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য প্রচুর গান লেখেন যা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ও পূর্ব বাংলার জনগণের মুখের গান, প্রাণের গান হয়ে ওঠে। মোরা একটি ফুল বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, পূর্ব দিগন্তে সূর্য্য উঠেছে রক্ত লাল, পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা – এগুলি তার প্রবাদপ্রতিম রচনা। শ্রোতার ভোটে তৈরী বিবিসি রেডিওর সর্বকালের সেরা ১০টি বাংলা গানের তালিকায় তার দুটি গান উপস্থিত। এই লোকটি মারা গেল, কোন বঙ্গশ্রী, পদ্মশ্রী ছাড়াই। আসলে সে ঠিক গান লিখেছিল ‘ভুল’ রাষ্ট্রের জন্য। তাই এপারে তার কল্কে নেই। আমাদের মধ্যেই ছিলেন এতদিন। জানতে চেষ্টাও করিনি, কারণ রাষ্ট্রর ক্ষমতা যত বেড়েছে, তা আমাদের মানুষ হিসেবে ছোট করে দিয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-ও একাত্তরে গোবিন্দ হালদারের নাম ফলাও করত না – সে ‘ভুল’ রাষ্ট্রের যে। পরে ঋণ শোধের চেষ্টা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার চিকিত্সার খরচ পাঠিয়েছেন, সরকার পুরস্কৃত করেছেন, রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ কলকাতায় মৃত্যুপথযাত্রী গোবিন্দ হালদারকে দেখে গেছেন। আমার কাছে একটা ছবি আছে – বৃদ্ধ গোবিন্দ হালদার বাংলাদেশের পতাকা নিজের বুকের কাছে ধরে আছেন। পার্টিশন এলাকার যারা নন, একদেশ-একজাতি-একরাষ্ট্র রাষ্ট্রের গর্বে বলিয়ান যারা, হয়ত ভাগ্যশালী তারা,কিন্তু তাদের কি করে বোঝাব এসব ? হয়ত তারা বুঝবে পরজনমে, রাধা হয়ে। তখুন হয়তো তারা অনুভব করবে গোবিন্দ হালদারদের দেশের ঠিকানা।

কেউ কেউ কিন্তু তলে তলে বোঝে। ঢাকার অভিজিত রায় – খ্যাতিমান মুক্তমনা ব্লগার। ২৬ তারিখে , একুশে বইমেলা থেকে ফেরত আসার সময়ে তাকে রামদা দিয়ে হত্যা করা হলো। তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। দায় নিয়েছে ইসলামী সংগঠন আনসার বাংলা-৭। প্রতিবাদে এ বাংলার কিছু মানুষ ২৭এই কিন্তু জমায়েত করলেন যাদবপুরে। নিষিদ্ধ প্রেম পরিণত হয় নিষিদ্ধ কান্নায়, কাঁটাতার ভেদী শপথে, চোরাগোপ্তা। সব রং তেরঙ্গায় নেই।

Leave a comment

Filed under বাংলা, Bengal, Culture, Delhi Durbar, Dhaka, Foundational myths, Kolkata, Language, Nation, Open futures

রাম ও রামীর পয়লা ফাল্গুন

কালকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে।  আপনার জীবনে যদি প্রেম-পিরিতির কেউ থাকে এবং  নগদ টেকা-টুকা থাকে, তাহলে এটা আপনার আধুনিক  নাগরিক কর্তব্য যে আপনি কাল চকোলেট কোম্পানি, মাল্টিপ্লেক্স কোম্পানি, রেস্টুরেন্ট কোম্পানি, গ্রিটিং কার্ড কোম্পানির মতো হরেক কোম্পানিকে কাল বেশি মুনাফা দেবেন।  আপনি উত্তরাধুনিক  নাগরিক হলে দেবেন ডার্ক চকোলেট, দেখবেন আর্ট ফিলিম, দেবেন অন্যের হাতে আঁকা কার্ড।  খাবেন  রেস্টুরেন্টে কারণ কুকিং বর্জন প্রগতিশীলতার এক প্রাথমিক শর্ত। এই সকল মাজারে চাদর না চড়ালে আপনার প্রেম খাঁটি নয়। যারা নরসিংহ রাও পরবর্তী যুগে লায়েক হয়েছেন, তাদের অনেকের এতদিনে প্রতি ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে যা যা প্রেমের প্রমাণ জমেছে, তার একটা আর্কাইভ করলে বেশ একটা সমাজতাত্ত্বিক ব্যাপার হবে। কিছু ক্ষেত্রে এই উপহারের আর্কাইভ আবার অনেকের সিরিজ প্রেমের আর্কাইভ ও বটে – কে কার পেছনে কত টাকা খরচ করলো বা করলো না, স্মৃতির মনিকোঠায় সেই অনুযায়ী বরাদ্দ থাকে বর্গফুট কার্পেট-এরিয়া। হয়ত যারা কালচার-ফাল্চার স্টাডি করে শ্বেতাঙ্গদের কাছে দিশি মানুষের জীবনকে উজাগর করে নাম কামান, তারা দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু পুঁথিও লিখে ফেলবেন। আমার কথা নিশ্চই তেকেলে জ্যাঠার মতো  শোনাচ্ছে।  আমার ঠাকুরদার বাপ, আমার ঠাকুরদা, আমার বাপ – এরা সকলেই কুলের বড় ছেলে, অতয়েব নানা মানুষের জ্যাঠা। আমি এদেরই ডাইরেক্ট উত্তরসুরী। আমি মূলতঃ চট্টোপাধ্যায়।  গর্গ নামটি উছিলা মাত্র।

বাংলা জুড়েই একটি খাঁটি বাঙালি জিনিস আমার আপনার সকলের আছে। এটাকে বাংলায়ে বলে ফিলিংস। অনেকে এই মোক্ষম দিনে এহেন মোক্ষম ফিলিংস প্রকাশ করেন প্রথম বার। কে বলে যে শুধু আমরাই পাজি দেখে শুভ কাজ করি? আপনারা যারা আধুনিক-উত্তরাধুনিক – তার বেলা ? এই যে চেনা ছকে চেনা কোম্পানির চেনা উপহার দিয়ে চেনা ফিলিংস-কে দৃঢ় করা, এ কি “রিচুয়াল” না ? যত স্বকীয়তা আর স্বতস্ফুর্ততা, তা আপনাদের ক্রেতা-আচরণে? আর যত দোষ ও ব্যাকওয়ার্ড রিচুয়াল আমাদের সিন্নি চটচটে ধুনো ধূমায়িত পরিসরে ?

যখন প্রেম-পিরিতির সম্পর্কে যা গভীরত্ব জানান দিতে হয় বাজারী জিনিসপত্রের মাধ্যমে, এবং প্রেম-পিরিতির যাচাইও হয় বাজারের নিরিখে, তখন সে ভালবাসা সর্বার্থেই অর্থপূর্ণ। বাজার আজকে মোটামুটি এটা বুঝিয়ে ফেলেছে যে চাষের জন্য যেমন লাঙ্গল দরকার (বড়লোক হলে ট্রাক্টর), তেমনই ১৪ ফেব্রুয়ারী প্রেমের জন্য ফুল-চকোলেট দরকার (ধনকুবের হলে ছোট্ট হীরে)।  মনের সঙ্গে মালের এই সহজ কিন্তু কুটিল সম্পর্ক প্রথমতঃ কল্পনার শত্রু। দুইটি মানুষ যখন এই দিনকেই ইস্পেসাল করে তোলে, এই দিনেই জিনিস -প্রদান করে, তারা নিজেদের স্বকীয়তাকে গৌণ  করে দেয়। রামা-শ্যামা-যদু-মধু সকলেরই প্রেম একদিন বেশি করে জাগে, একই দিনে তারা চেনা চকে চেনা জিনিস করে, তা রাম ও রামীর অথবা রাম ও শ্যামের যে নিজস্বতা, তাকেই নস্যাত করে।  দুই প্রেমীর কাজ হয়ে যায়  গ্লোবাল সংস্কৃতির পাতায় সামান্য ফাঁকা জায়গায় নিজেদের নাম লেখা – ফিল আপ দি ব্ল্যান্ক। বাকিটা এক। কিন্তু মানুষ তো এরকম এক না। তাই পিরিতির এই ভালেন্তিনীয় প্রকাশে কোন কোন সম্ভাবনার মৃত্যু হয় ? নগদ-হীন ভালবাসা প্রকাশে কার লাভ, কার ক্ষতি? কাগজে ছাপাঅশোকস্তম্ভের সিংহের কাঁধে ভর করা এ কোন ভালবাসা ?  অশোক স্তম্ভ ছাড়া যেমন ভারত রাষ্ট্র নেই, চকলেট-খানাপিনা-সিনেমা-ফুল-গিফটের মোড়ক ছাড়ালে যেটা বাকি থাকে, সেটা কি ? এগুলি না থাকলে, কি বাকি থাকে? কাদের ক্ষেত্রে বাকি থাকে, কাদের ক্ষেত্রে থাকে না ? এগুলি স্রেফ প্রশ্ন।  কার ভালবাসা খাঁটি আর কারটা মাটি , সেটা মাপার  জ্ঞান আমার নেই। তবে গদাধর চট্টোপাধ্যায় বলে গেছেন – টাকা মাটি, মাটি টাকা। মা সারদা আজকাল টাকার ব্যাপারে কম বলছেন, মাটি নিয়েই মনোযোগ বেশি। মার্কিন দেশে ২০১৩-তে একেকজন মানুষ গড়ে ৭৮০০ টাকা খরচা করেছেন ভালেন্টাইনস ডে  বাবদ। যদি মার্কিনি হয়োনের শখ থেকে থাকে, তালে ওই ৭৮০০ সংখ্যাটিকে পাখির চোখ মনে করে এগিয়ে চলুন। খ্রিষ্টীয় সন্ত ভালেন্টাইন আপনার সহায় হোন।

ভ্যালেন্টাইন্স ডে আমাদের বাংলাদেশের জনজীবনে, বিশেষতঃ শহুরে এলাকায় একটা জায়গা করে নিয়েছে।  জায়গা করে নিয়েছে আরো অনেক কিছুই।  এসবের ক্ষেত্রে একটা কথা খুব শোনা যায়।  চয়েস।  আমি যা চাইব। আমি চাই ভ্যালেন্টাইন্স ডে – এটা আমার চয়েস।  ভালো কথা।  কিন্তু চয়েস বা বাচাবাচির মধ্যে  যা বাছা হয়, তা যাপনে হোক, ভাষায় হোক, বসনে হোক, দিবসে হোক – তার ভৌগোলিক উত্পত্তিস্থল যদি পৃথিবীতে সংখ্যালঘু যে শ্বেতাঙ্গ মানুষজন, তাদের  এলাকা থেকেই আগাপাশতলা আমদানি করা হয়, তাহলে চয়েস আসলে বাড়ে, না কমে ?  বিশ্বায়নের ফলে তো আমাদের  বিশ্ব আরো ব্যাপ্ত হবার কথা ছিল – বসনে, ভূষণে, ভাষায় সবেতে বৈচিত্র বাড়ার কথা ছিল।  তাই না ? গলদটা কোথায়?  তার জন্য হয়ত আমাদের এই ১৪ ফেব্রুয়ারির বাংলায় আমদানির গল্পটি জানতে হবে, সেই আমদানির ফড়েদের কথা জানতে হবে, আমাদের কল্পনা ও ফিলিংস কেমনে  শ্বেতাঙ্গ পপ-কালচারের গারদে আটকা পড়ল, সেটা একটু ভাবতে হবে। শ্বেতাঙ্গ আক্সেন্ট ও জোক্স মুখস্ত করতে করতে আমরা আমাদের বগল ও কুঁচকি দেখতেই ভুলে গেছি। ময়লা জমবেই।  তখন সেন্ট যদি আমদানি করতে হয়, সায়েবের কি দোষ ?

আমি যখন মার্কিন দেশে থাকতাম, তখন ১৪ ফেব্রুয়ারীকে কেন্দ্র করে নানা জিনিস নতুন মোড়কে পাওয়া যেত।  ১8 তারিখ কাটলেই সেগুলির দাম হয়ে যেত অর্ধেক।  আধুনিক ও উত্তর-আধুনিকদের  বিশ্বেও  তিথি অনুযায়ী জিনিসের দর বারে কমে, ঠিক কোজাগরী লক্ষী পুজোর দিনে সবজির মত। এবার ভ্যালেন্টাইন্স পড়েছে পয়লা ফাল্গুনে।  শুনতে কি বোরিং লাগছে না? পয়লা ফাল্গুন আর ১৪ ফেব্রুয়ারী কি এক হলো ?

Leave a comment

Filed under বাংলা, Bengal, Community, Culture, Language, Sahib

মুকুল ঝরবে?

তৃণের নানা ঋতুতে নানা রূপ। ঘোর বর্ষায় তা রসালো। মাটির সঙ্গে তার সংযোগ – মাটি থেকেই তার উদ্ভব। প্রখর গ্রীষ্মে তা শুকনো – বেড়ে ওঠার সময়ের প্রাণরস শুকিয়ে গেলে, মাটির সাথে নিবিড় সম্পর্ক আলগা হলে, পড়ে থাকে হলুদ বহিরঙ্গ । শুকনো তৃণের একটি বৈশিষ্ট হলো কোথাও একটু আগুন লাগলে, তা দ্রুত ছড়ায়।  নিমেষে শুকনো তৃণের বিরাট মাঠ ছাড়খার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আগুন লাগার জন্য একটা স্ফুলিঙ্গ দরকার। বিনা আগুনে মাঠও পোড়ে না,  আবার বিনা আগুনে ছেলের বিয়েতে কোর্মা বিরিয়ানী রান্নাও হয়না। স্ফুলিঙ্গের অস্তিত্ব তাই অনেকটা বিরিয়ানীর গন্ধের মতো। যা রটে, তা কিছুটা বটে। এই কিছুটা আসলে ঠিক কতটা, নাকি অনেকটা, নাকি পুরোটাই , তা আমরা কেউ-ই জানি না। যে সকল  ঠাকুর-দেবতারা সবার  ভেতরের সব কিছু  জানেন, তারা মানুষের সাথে সচরাচর কথা বলেন না। আর যারা সংবাদমাধ্যমের কানে কানে এই ‘কতটা’র গল্প নিয়মিত চালান করেন, তারা স্রেফ ভানে দেবতা, প্রাণে আর সকলেরই মত ধান্দাবাজ মাত্র। হ্যা ভাই, দিল্লীকে স্যালুট করা ভয়-শুন্য চিত্ত উচ্চ-শীর লোকগুলি ঠিক আর বাকি সকলেরই মতো। শুধু টিকিটি অন্য জায়গায় বাঁধা, তফাত এই যা। ‘বিশেষ’ সূত্রের জনকেরা বড়ই সাধারণ।  তফাৎ নেই শিরদাঁড়ায় – সে শিরদাঁড়ার রং লাল হোক, তেরঙ্গা হোক, গেরুয়া হোক, খাঁকি হোক বা জলপাই হোক। বিশেষতঃ খাঁকি বা জলপাই-দের বিশেষ সুত্র বা ভেতরের সূত্র সাদা পোশাকের পুলিশের মতোই সততা ও সত্যতার মহান প্রতীক। তাই সাধু সাবধান।

তৃণের মাঠ পুড়ে  ছারখার হলে সেখানে স্বপ্নের নীড়  গড়ার যারা স্বপন দেখছে, তারা জানে সে শহর কলকাতার কনক্রিটের মাটির থেকে কলকাতার পাশে জলাজমি, বোজানো জলাজমি ও দখলি ফসলিজমিতেই পদ্ম ফোটার সম্ভাবনা বেশি। ঝুপড়ি-বস্তিহীন এলাকাতেই পদ্ম-তদ্ম বেশি মানায় – বিউটিতা খোলতাই হয় ।  এক সময় শিরে সংক্রান্তি হওয়াতে শহর কলকাতায় কমরেডরা আওয়াজ তুলেছিলেন – মেগাসিটি গড়বে কে? ভাগ্যিস রক্ত দিয়ে মেগাসিটি গড়া যায় না (আসলে রক্তিম ধাপ্পা দিয়ে বক্রেশ্বর-ও গড়া যায়না ওইভাবে , তবে সে অন্য প্রসঙ্গ)। মেগাসিটির অবসরপ্রাপ্ত নায়কেরা বিধান-বাবুর বস্তিহীন নগরে প্লট-টট গুছিয়ে নিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। আর দেকছেন, বুঝছেন, ভাবছেন – দেশ ও দশের কথা। এদিকে মেগাসিটি গড়ার জন্য রাজারহাট-এর নাম থেকে তার পরিচিতি সরিয়ে নিউটাউন হচ্ছে – যা এক-কালে হযেছিল ‘বিধান-নগর’-এ। মানুষের স্মৃতিকে ক্ষমতাবানদের বড় ভয়, বিস্মৃতি বড় ভরসা। তাই তো কলকাতা ও বিধান-নগরের সীমান্তে শানু লাহিড়ীর ‘পরমা’ ভাস্কর্যকে গুঁড়িয়ে দেওয়া যায় অবলীলায় – সেই ভাস্কর্য যার নামে পরমা আইল্যান্ড , সেই পরমা যেখানে এসে পার্কসার্কাস থেকে ফ্লাইওভার আসছে তো আসছে, আসছে তো আসছে। ঠিক বাংলার যুব সমাজের কাছে প্রতিশ্রুত লক্ষ লক্ষ চাকরির মত, ঠিক সারদার আমানতকারীদের কাছে প্রতিশ্রুত বিপুল লাভের গুড়ের মত। পরমা নেই, আছে এক গোলক – যাতে পথচলতি মানুষ ঠিকঠাক বুঝে  নেয় বিশ্বে বাংলার স্থান ঠিক কোথায় আর লন্ডনের স্থান-ই বা কোথায় – তাদের মধ্যে দুরত্ব কতটা।  দুরত্ব কমাতে ‘কাছের মানুষ, কাজের মানুষ’রা বদ্ধপরিকর। তাই তো এই বাংলার স্বনামধন্য আপন শিল্পীর স্থাপত্য ধ্বংসের সাথেই চলছে  লন্ডনের বড় ঘরি-স্তম্ভ ‘বিগবেন’-এর  একটি চটুল নকল বানানোর অশ্লীল পরিকল্পনা। টেমস নদীর ন্যায় নদী পার হওয়া ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর মতই আসছে তো আসছে। তাই  দুধের স্বাদ  ঘোলে মেটানোর পরিকল্পনা – খালপাড়ের বিগবেন।  আমরা আশায় আশায় বাঁচি। এই আশা বা ‘হোপ’-এর বাপ হোপ ৮৬-র সম্রাট তার পুত্রের সংগ্রামী মানস-পুত্রের ঘড়িস্তম্ভের কথা শুনে বলতেন ‘বাপ কা বেটা’। কিন্তু আফশোস, দুধ হোক বা ঘোল, তার জন্য নিদেনপক্ষে গরু দরকার। যেদিন ওই নকল বিগবেন-এ বারোটার ঘন্টা বাজবে – সেদিন সকল কাগজেই আধপাতা বিজ্ঞাপন হয়ে তা জানান দেবে। বলদ বলদ-ই। গরু নয়।

মুকুল ধরতে শুরু করেছে শহরের বেঁচে থাকা কয়েকটি আমগাছে।  মুকুল যখন ধরে, তখন সারা গাছ ভরে যায়। অন্য সকল পাতা ঢেকে যায়।  দেখে মনে হয় যেন  মুকুলেরই গাছ। হুগলী  জেলায়  আমার গুষ্টির আদি ভিটা।  সেখানে আমাদের এজমালি আম-বাগান আছে।  তাই আমরা জানি যে মুকুল ধরল মানেই যে সেবার আমের ফলন ভালো হবে, এমন নয়।  মুকুল ঝরে যেতেই পারে – ভেতরের রোগে, বাইরের আবহওয়া বদলে। এই বঙ্গের ভাগ্যবিধাতারা দিল্লিতে থাকেন – তার বঙ্গের লজ্জা। এ লজ্জা অন্য সকল রাজ্যেরও। দিল্লী হতে ঠিক হয় মুকুল ঝড়বে কি ঝড়বে না।  তাই উড়ে চলো দিল্লী। বঙ্গের ভেতরে যে সারদা রোগ তা অবশ্য দিল্লীর সাহারা রোগ ও অন্যান্য মহারোগের তুলনায় নস্যি। কিন্তু রোগ রোগ-ই।  সে ক্যাঁক করে কাকে ধরবে, তা ২৭২+ এর যুগে বলা শক্ত। এখুন পর্যন্ত যাদেরকে রোগে ধরেছে, তারা কিন্তু বেজায় ভয় পেয়েছে।  আমি তো পেতাম।  তবে তাদের  সাথে আমার তুলনা চলে না।  আমি ল্যাম্প-পোস্ট ও নই। আমার পেটে লাথি  মারলেও গৌর-নিতাই ত্রিফলা বাতি জ্বলবে না। এই  সপ্তাহে আমগাছের দিকে চোখ রাখুন – মুকুল ঝড়বে না কি  ঝড়বেনা ?

তবু আমগাছের মুকুলের ঝরঝরে হবার বা ঝরে পড়ার এই দিনে যে সংগ্রামী কমরেডরা পাশে দাঁড়িয়ে মজা দেখছেন, সেই  দুর্বৃত্ত ফসিল-গুলিই গত  কয়েক দশক ধরে বলত কেন্দ্রের গা-জওয়ারীর কথা। আজ যখন দিল্লী থেকে বর্গি এসে তাদের শত্তুরকে কোণে নিয়ে গিয়ে কম্বল-ধোলাই দিচ্ছে , তখন তাদের একইসাথে হাত-তালি ও  নিস্তব্ধতাকেও মনে রাখা দরকার।  পরে কাজে দেবে। কেউ নিজে খাল কেটে আসে না – কেটে আনানো হয়। দিল্লি থেকে কলকাতা – লম্বা এই খাল। যে চির-সংগ্রামী  কমরেডরা ভাবছেন যে বাংলায় গ্রেফতার ও গুজরাতে  সাত খুন মাফের খেলায় তারা এখানে হাততালি, ওখানে গালি দিয়ে ঘোলা জলে মাছ ধরবেন, তারা এই ঘোলা জলে কব্জি ডোবালেই  বুঝবেন খাল কেটে কি জীব তারা ঢোকাচ্ছেন। এখুন  তো কলির সন্ধে। আমের ফলন কেমন হবে, তা ঠিক হতে এখুন দেরি  আছে।

Leave a comment

Filed under বাংলা

ডাক্তার ও মেরুদন্ড

ডাক্তারের অন্যতম কাজ রোগ নির্ণয়। কিন্তু এসএসকেএম হাসপাতাল-এ গত বেশ কয়দিন যাবৎ যে প্রহসন চলল, তাকে রোগ ‘আবিষ্কার’ বলা যেতে পারে। কিন্তু অচেনা ভুতের ভয় ছাড়া অন্য কোন রোগ আবিষ্কৃত হলো না। ডাক্তারবাবুরা কিন্তু যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। খুব চেষ্টা করেছিলেন। কি হতো যদি প্রথম দিনেই দেওয়া হত ‘ফিট’ সার্টিফিকেট? কি হারাতেন তারা? সরকারী চাকরি যা কিনা হারানোর কোন ভয় নেই – মাসে লাখটাকার অনেক বেশি মাইনে। মনুষ্যরুপী দেবতা ইমেজটা তার সাথে একদম ফ্রী। কি হারাতেন তারা যদি তারা বলতেন সূর্য্য পূব দিকে ওঠে , অথবা, যদি জানিয়ে দিতেন যে পৃথিবী সুর্য্যকে প্রদক্ষিণ করে ? একটা জেলা শহরে ট্রান্সফার, খুব বেশি হলে। বঙ্গবাসীর চরম দুর্ভাগ্য যে কোন এক সুদূর অতীতের পাড়ার মেধাবী ছাত্র জেলার গর্ব বাপমায়ের আশাভরসা এককালে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক-ডাক্তারি প্রবেশিকা-ডাক্তারি পরীক্ষা সবেতে ভালো ভাবে পাশ দিয়ে অভিজ্ঞতায় নুব্জ হওয়া রত্নদের মধ্যে ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়’ বলার মত একটিও মানুষ পাওয়া গেল না মেডিকেল বোর্ড-এ। অথচ মালিন্গেড়িং বা রোগের নাটক করাকে কি ভাবে ধরতে হয়, তার শিক্ষা তো এমবিবিএস করার সময়েই দেওয়া হয়। এনারাই তো সংবাদমাধ্যম এড়িয়ে টুক করে গাড়িতে উঠলেন। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে হুশ করে বেরোলেন। চেম্বার সেরে বাড়ি ঢুকলেন। হয়ত সন্তানের সাথে চোখাচোখি হলো। সে মুহুর্তে আগামী প্রজন্মের চোখে ছোট হলেন না বড় হলেন নাকি বুদ্ধি খাটিয়ে শাক দিয়ে মাছ ঢাকলেন , ম্যানেজ দিলেন। হয়তো মনে হলো, কেউ জানতে পারল না। যে মা মুখ দেখলে বুঝে ফেলতেন মিথ্যা বলছেন কিনা, তিনি তো কবেই চোখ বুজেছেন। আর কোন সাক্ষী নেই, আয়না নেই। সভ্যতা ভুলে গেছে, মেরুদন্ডি প্রাণীর উদাহরণে একদিন কি বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল মানুষের। কোন পাঠক মনে করাবেন কবির নামটা?

সত্যই কি কেউ জানতে পারল না? এই তো সেদিন অবধি মেডিকেল কলেজে ছাত্রাবস্থায় বন্দেমাতরম জয়ধ্বনী দিয়ে ছাত্রপরিষদ করছিলেন – সরকারী গান্ধীবাদের। কাজে ঢুকে হয়ে গেলেন এইচএসডি – কমরেডি কৃপা ও সান্নিধ্যের লোভে । আজকে পরিবর্তনের যুগে ‘প্রগ্রেসিভ ডক্টর’-এর অগুরু আতর গায় লাগিয়ে আবার সেটিং করে নিয়েছেন, কালকে পদ্মপাতায় নজনের মধ্যে জায়গা হবে কিনা, তার হিসেব ও করছেন আজকাল একটু-আধটু। ছাতা-জার্সি সব বদলেছেন ভয়ে ভয়ে – কখনো প্রোবেশন, কখনো প্রমোশন, কখনো ট্রান্সফার, কখনো উচ্চাকাঙ্খা, কখনো ভিজিলেন্স। খবরটা এবেলা জানিয়ে রাখি – আপনার বিশ্বরূপের সাক্ষী আছে। সেই অন্তরাত্মার মালিক সাক্ষী, এই দিন দুনিয়ার মালিক সাক্ষী, মা দূর্গা-মনসা-চন্ডি-শীতলা সাক্ষী, ধর্মঠাকুর সাক্ষী, নার্স দিদি সাক্ষী, গ্রুপ-ডি ষ্টাফ সাক্ষী, এমনকি আপনার পোষা ড্রাইভার-ও সাক্ষী – অধঃস্তন বলে সামনে কিছু বলে না। দেবতারা ডাক্তারদের খুব ভালবাসেন। নইলে প্রতিদিন পূর্বের পাপস্খালনের এত নিত্য-নৈমিত্তিক সুযোগ তৈরী করে দিতেন না তারা। ভাবেন তারা উপরে বসে ‘এবার তো সুযোগটা নে, কালি মোছ।’ দয়াময় সুযোগের পর সুযোগ দ্যান – আর সুযোগগুলি দিনের শেষে শুকিয়ে যায় উচ্ছিষ্ট ভাতের মতো। আরো টেস্ট করা দরকার – হৃদয়, মল, মুত্র। কিছু একটা পেতেই হবে, অথবা দেখাতে হবে যে পাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। সভ্যতা ভুলে গেছে, মেরুদন্ডি প্রাণীর উদাহরণে একদিন কি বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল মানুষের।

মেরুদন্ডী গুরুর ছাত্র হয় মেরুদন্ডি। আর জার্সি-বদল ‘নির্বিবাদ’ ‘ঝামেলা এড়ানো’ গুরুর ছাত্র হয় কোরপান শাহ-এর হত্যাকারীরা। যারা মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষটাকে অত্যাচার করে খুন করলো, তারা হত্যাকারী, তারা সংখ্যায় বেশি না , এক বাটি দুধে একটুখানি চোনা । আর যারা, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল – সেই সংখ্যাগুরু সোনার টুকরো প্রত্যক্ষদর্শিরা ? এদের তো বলতেও হবে না , ‘মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছু দেখেননি’। এরা এখুনি সব দেখেও না দেখতে, সব জেনেও মুখ বন্ধ রাখতে শিখে গেছে। এরা আসছে দিনে ডাক্তারী মাষ্টারমশাই হবেন। সামনের দিনে আরো দীর্ঘায়িত হবে মেডিকেল বোর্ডের রোগ-আবিষ্কার নাটক। জার্সি-বদল হবে অহোরহ। অনেকে একই জার্সি-তে নানা পতাকার তালি লাগিয়ে কাপড় সাশ্রয় করবেন। নব যুগের ফকিরী সাজ। কারণ দেড় লাখি মাইনের ডাক্তার-ও অমেরুদন্ডি হবার কারণ হিসেবে বলেন ‘পেটের দায়’। সভ্যতা ভুলে গেছে, মেরুদন্ডি প্রাণীর উদাহরণে একদিন কি বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল মানুষের।

একদিন ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার পরে বাংলা থেকেই কত ডাক্তার ছুটে গেসলো, আরো পরে পাশে দাঁড়িয়েছিল কানোরিয়া জুট-আন্দোলনের। তাদেরই রেশ দেখা গেছে বন্যা-ত্রাণে, আইলায়ে, নন্দীগ্রামে। ৮০-র দশকে এই বাংলা থেকেই চিকিত্সক-রোগী উভয়ের কল্যাণের দাবি নিয়ে হয়েছিল ঐতিহাসিক জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলন। পাশে দাঁড়িয়েছিল সরকারী ডাক্তারদের অদলীয় সংগঠন। লোভ, ভয় ও হুমকি দিয়ে তত্কালীন সরকার সে সংগঠন ভাঙ্গিয়ে দলদাস ডাক্তার গোষ্ঠী গড়ে তোলে। লজ্জার ইতিহাস বেশ পুরনো। দল-দাসত্বের লাভ অনেকে কড়ায়-গন্ডায় উসুল করেছেন – সল্টলেকে প্লট নিয়ে, ট্রান্সফার আটকে দশকের পর দশক কলকাতায় থেকে গিয়ে, মেরুদন্ডি ডাক্তারদের প্রমোশন আটকে, বারবার দূরে ট্রান্সফার করিয়ে। লাল পতাকাধারী কেষ্টর সুযোগ্য উত্তরসুরী হলো সাদা কেড্স পরা তেরঙ্গা বিষ্টু। আগে পেছনে ‘স্যার স্যার’ করার জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়েছে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে। অথচ, মেরুদন্ডি প্রাণীর উদাহরণে একদিন কি বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল মানুষের।

এই তো সেদিন, কোরপান শাহ-এর বধ্যভূমি এনআরএস-এই সূর্য্য উঠেছিল।মিথ্যা কেসে সন্ত্রাসবাদী তকমা পাওয়া ছত্তিশগড়ের আদিবাসী স্কুল-শিক্ষিকা সোনি সোরির যোনির গভীরে পাওয়া গেল পাথরের একাধিক টুকরো ও পুলিশী অত্যাচারের অনেক চিহ্ন। ফরেন্সিক ডাক্তারের রিপোর্ট বুঝিয়ে দিলো ছত্তিশগড়ের পুলিশ-গোয়েন্দারা অপরাধী, মিথ্যাবাদী, অত্যাচারী। আজ-ও এমন শিরদাড়াওয়ালা ডাক্তার থাকতে বিভুষণের শাল দেওয়া হলো দাগী আসামিকে? শাল-এর এতই আকাল ? কোরপান হত্যার নিশ্চুপ সাক্ষীদের কেউকেউ কাল ফরেন্সিক ডাক্তার হবে। তখন যোনির মধ্যে আটকে থাকা রাষ্ট্রের প্রেম-মাখা পাথরের টুকরোর খবর থাকবে কি মেডিকেল রিপোর্ট-এ ? কালকের সোনি সোরীরা, আমার বোনেরা ভায়েরা মায়েরা থার্ড ডিগ্রীর চিহ্ন নিয়ে কোথায় যাবে? আমার যে খুব ভয় করছে।

Leave a comment

Filed under Army / police, বাংলা, Bengal, Terror, Under the skin

লাভ জেহাদ – তথ্য কই ?

[ ArekRakam]
অধিকাংশ মানব সমাজেই বিবাহ বা তারই কোনো অন্য সমাজ-স্বীকৃত রূপকে মানব-মানবীর প্রেমের স্থায়ী বন্ধনের সবচেয়ে বিশুদ্ধ রূপ বলে মনে করা হয়।  যদিও বাজারে প্রেমে ‘অন্ধ’ হওয়ার কথাটি বেশ চালু আছে, সমাজ স্বীকৃত সম্পর্ক বা নিজেদের রেডিকাল বলে প্রচার করা মানুষদিগের তথাকথিত ‘বিকল্প’ সম্পর্ক-ধারনায় হোক, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার চোখ অন্ধ তো নয়,বন্ধ ও নয়।  যদি বিবাহের দিকেই তাকানো যায় , তাহলেই দেখব যে ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, জাত, ভাষা অথবা এ সকল জিনিসের এক সংমিশ্রণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্পষ্ট ভাবে নির্ধারক ভূমিকা নেয়। তাদের ব্যক্তিগত আদর্শ বা চিন্তাধারার কারণে এহেন অবস্থাকে কেউ কেউ অপছন্দ করতেই পারেন, কিন্তু এটাই সামাজিক বাস্তবতা।  শুধু ‘সাধারণ’ মানুষ নন, স্ব-আখ্যাত ‘অসাধারণ’ ও ‘রেডিকেল’ মানুষজনেরও যুগল ভাবনা মুখের বুলিতে যাই হোক, বাস্তবে তাদের
বাছ-বিচারেও ‘সাধারণ’-এর মাপকাঠিগুলিই প্রকট। চড়া গলায় প্রকাশ্য দ্রোহের অন্তরালে দেখা যায় যে ‘অসাধারণ’ রা আসলে সাধারণ।  ক্রিষ্ঠান ধর্মাবলম্বী পরিবারে জন্মানো শ্বেতাঙ্গ পুরুষ-মহিলাগণ, যাদের জীবন ,
আদর্শ ও দর্শন অনেকাংশেই শহুরে দিশি ‘রেডিকেল’ দের অনুপ্রাণিত করে, সেই নরোত্তমেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই ক্রিষ্ঠীয় বংশোদ্ভূত শ্বেতাঙ্গ পরিবারের কাউকেই বিবাহ করে। নানা রকম ‘কসমোপলিটান’ কল্পনার শাক দিয়ে এই মাছ ঢাকার অপচেষ্টা চললেও, এটাই ঘটনা। সংখ্যাগরিষ্ট কে লঘু করে দেখানো আর সংখ্যালঘু কেকে ফাঁপিয়ে দেখানোটা ঈসপের ল্যাজ-কাটা শেয়ালের কৌশলের অংশ।একটা জিনিস বুঝে নেওয়া দরকার। কিছু মহলে, ভিন্ন ধর্ম বা ভাষা বা জাতীয়তার মানুষের মধ্যে বিবাহকে কিছুটা ‘উচ্চতর’ মর্যাদা দেওয়া হয়। যেন এগুলি সাধারণ বিবাহের থেকে একটু উচ্চকোটির জিনিস।  নিজেদের পারিবারিক
ধর্মের মানুষকেই বিবাহ করেন মানব জাতির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ। ভালো-মন্দ অপ্রাসঙ্গিক। এইটেই বাস্তব।
‘লাভ জেহাদ’ হলো এমন এক ঘটনা যেখানে মোসলমান পুরুষ পূর্ব-পরিকল্পিত ভাবে অ-মোসলমান নারীকে বাছাই করে, অনেক ক্ষেত্রে নিজের মোসলমান পরিচয় গোপন করে  তার সাথে  প্রেম, বিবাহ বা যৌনাচার বা সবকটিই করে শেষ অবধি তাকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করার উদেশ্যে বা অ-মোসলমান নারী ও তার সমাজের সম্ভ্রম-হানি ঘটানোর উদ্দেশ্যে। পাকিস্তানে (বিশেষত সিন্ধু প্রদেশে) ও ইংলন্ডে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে। ভারতীয় ইউনিয়ন-এ কেরল, কর্নাটক ও সম্প্রতি উত্তর প্রদেশ  থেকে এমন কিছু ঘটনার অভিযোগ এসছে।  এই ঘটনাগুলিতে পুলিশী তদন্ত কিন্তু এমন কোনো ব্যাপক তথা পূর্বপরিকল্পিত ‘লাভ জেহাদ’-এর মত ঘটনার  প্রমাণ পায়নি।  উত্তর প্রদেশের মতো এলাকা, যেখানে সাম্প্রদায়িক রেষারেষির সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, সেখানে এই ‘লাভ জেহাদ’ নিয়ে ব্যাপক প্রচার চলেছে কট্টর হিন্দুত্ববাদী কিছু চক্রের সাহায্যে।
ভারতীয় ইউনিয়ন-এ যে আইন প্রচলিত আছে, তাতে কোনো মোসলমান পুরুষ-এর কোন অ-মোসলমান নারীর সাথে প্রেম বা বিবাহ করতে বাধা নেই, বাধা নেই সেই মহিলাকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করতেও। একই ভাবে, কোন হিন্দু পুরুষ-এরও কোন অ-হিন্দু নারীর সাথে প্রেম বা বিবাহ করতে বা ধর্মান্তরিত করানোতে বাধা নেই।  যখন এই জিনিসগুলি ঘটে, তখন খাঁটি প্রেমের কারণে হয় নাকি মনের গোপনে গোপনে তা কেউ অপর ধর্মের নারী-দের ফাঁসানোর উদেশ্যে করে, তা জানতে মনের খবর জানার যে প্রযুক্তি প্রয়োজন, তা ভাগ্যিস এখুনো কল্পবিজ্ঞানের স্তরেই আছে। কিন্তু কেউ যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে পরিচয় গোপন করে (  উদাহরণ স্বরূপ, কোন হিন্দু পুরুষ যদি তার হিন্দু পরিচয় গোপন করে সে মোসলমান , এমন ধারণা দেয়ে কোন মোসলমান নারী-কে আকর্ষিত করতে), সে ক্ষেত্রে ব্যাপারটা জালিয়াতি বলেই গন্য করা উচিত এবং এর পিছনে অন্য অসাধু উদ্দেশ্যের কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।  যদিও এমন জালিয়াতির ঘটনা কিছু পাওয়া-ও যায়, তার ভিত্তিতে এটা বলা  সম্ভব না যে এই ঘটনা বৃহত্তর কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ কি না। কিন্তু ‘লাভ জেহাদ’ নিয়ে যে উত্তেজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এ ব্যাপারে পরিষ্কার তথ্য সামনে আসা প্রয়োজন।  যখন তথ্য থাকে অপ্রতুল, তখন বাগাড়ম্বর, গুজব ও ঘৃণা-উদ্ভূত কল্পিত ‘তথ্য’-ই সত্যের স্থান দখল করে নেয়।  সেটা একটা বিপজ্জনক খেলা। অনেক সময় নিরীহ মানুষকে  রক্তে সে খেলার দাম চোকাতে হয়।
ভারতীয় ইউনিয়ন-এ প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী বর্তমানে অবিবাহিত যে কোন পুরুষ  বর্তমানে অবিবাহিত যে কোন মহিলাকে বিবাহ করতে পারে।  যদি কোন ধর্মের থেকে অপর ধর্মের মহিলাদের বিশেষ-ভাবে ‘টার্গেট’ না করা হয়, এ ব্যবস্থার ফলশ্রুতি হিসেবে বাস্তবে এই দেখতে পাওয়া উচিত যে হিন্দু স্বামী – মোসলমান স্ত্রী যুগলের সংখ্যা মোসলমান স্বামী – হিন্দু স্ত্রী যুগল সংখ্যার মোটামুটি কাছাকাছি। রাজ্য স্তরে বা জেলা স্তরেও এই প্যাটার্ন দেখতে পাওয়া উচিত।  তার থেকেও স্থানীয় স্তর-এ সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচার করার মত সংখ্যায় তথ্য নাও থাকতে পারে।  যদি রাজ্য স্তরে বা জেলা স্তরে দেখা যায় এক ধরণের যুগলের সংখ্যার সাথে  অন্য ধরণের যুগলের সংখ্যার অনেকটা অসাম্য রয়েছে, তখন বৃহত্তর কারণের কথা ভাবতে হবে।  কিন্তু ঘটনা হলো, এসব কোন তথ্যই কারো কাছে নেই।  এমন তথ্য কেন নেই, সে প্রশ্ন করা দরকার – বিশেষত যখন এই ধরনের ব্যাপার বর্তমান রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে এমন বিভেদকারী পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। ভারতীয় ইউনিয়ন-এ জ্ঞানীগুনী  গবেষকের কোনো অভাব নেই।  ভালো করে সমাজ-বিজ্ঞান ভিত্তিক একটা কাজ করে, জরিপ করে এগুলি জানতে পারা কি এতই শক্ত? দেশ ও দশের সামাজিক-রাজনৈতিক  জীবনের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক গবেষণাতে এহেন অনীহা এই উপমহাদেশের জ্ঞানী শ্রেনীর  সমাজ-বিচ্যুত অবস্থানের দিকেই দিক-নির্দেশ করে। অথচ টিভি তথা অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমে  প্রায়শই দেখা যায় পন্ডিত ও আলোচকদের , ‘লাভ জেহাদ’ সত্য বা মিথ্যা, এই নিয়ে জোর গলায়ে দাবি রাখতে, এক তিল তথ্য প্রদান না করেও।  এটা শুধু হতাশাব্যঞ্জক নয়, দায়িত্বজ্ঞানহীন ও বটে।
জনসংখ্যার ধর্মভিত্তিক অনুপাত ইত্যাদি নিয়ে উদ্বেগ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, দুইই বাস্তব। গুজরাটের সুরাবর্দি এবং অধুনা ভারতীয় ইউনিয়ন-এর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক সময়  নিয়মিত ভাবে তার রাজনৈতিক জমায়েত-এ মোসলমান সম্প্রদায়-কে ব্যঙ্গ করতেন  ‘হাম পাঁচ , হামারে পচ্চিস ‘ ( আমরা পাঁচজন , আমাদের পচিসজন ) বলে।  অর্থাত , এক মোসলমান পুরুষ, তার ৪ স্ত্রী, ও তার ফলে ২৫ টি সন্তান।  এর মাধ্যমে ইসলাম স্বীকৃত ও ভারতীয় আইন স্বীকৃত  মোসলমান পুরুষের বহুবিবাহের বৈধতার দিকে যেমন খোঁচা আছে, তেমনি আছে বেশি সংখ্যক সন্তান উত্পাদনের মাধ্যমে জন-সংখ্যার ধর্মভিত্তিক অনুপাত বদলানোর প্রচেষ্টার ইঙ্গিত। এই নিয়ে প্রচার ‘লাভ জেহাদ’ এর থেকে অনেক বেশি।  এই যে দাবি, যা নিয়ে প্রচার-ও বড় কম নয়, তার কি বাস্তব ভিত্তি আছে। অন্ততঃ বহুবিবাহ প্রশ্নে উত্তর স্পষ্টতই না।  কারণ এক্ষেত্রে তথ্য আছে। যতদিন আদমশুমারিতে বিবাহিত স্ত্রীর সংখ্যা গণনা করা হত, তার শেষ তথ্য ১৯৬১ সালের আদমশুমারির। তাতে আমরা কি দেখতে পাই? আমরা দেখি যে ৫.৭% মোসলমান পুরুষের একাধিক স্ত্রী আছে। অর্থাৎ মোটামুটি ২০ জন-এ ১ জন মোসলমান পুরুষের ১৯৬১ নাগাদ একাধিক স্ত্রী ছিল।  সেই একই সময়ে হিন্দু পুরুষের বহুবিবাহের হার হলো ৫.৮% – অর্থাৎ মোটামুটি এক, এবং চুলচেরা বিচার করলে অতি সামান্য বেশি-ই। অর্থাৎ বাস্তব তথ্য বহুবিবাহ সংক্রান্ত  মুসলমান-বিদ্বেষী প্রচারের বিপরীত।  ঠিক এই কারণেই তথ্য প্রয়োজন, প্রয়োজন সংখ্যার – ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত, আছে না নেই, এই সব দিয়ে পরিস্থিতি বিষনোর আগে।এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা ভালো যে ১৯৫৫ অবধি হিন্দু বহুবিবাহ-ও আইনত বৈধ ছিল। আজও মোসলমান সম্প্রদায়ের বিরুধ্যে অন্য সম্প্রদায়ের থেকে বেশি হারে বহুবিবাহের অভিযোগ আনা হয় হরদম কোন তথ্যের ধার না ধেরেই।
তথ্য ভিত্তিহীন প্রচারের ভুক্তভোগী কুলীন ব্রাহ্মণেরাও।  রাজনৈতিক প্রচারে, ব্যঙ্গে এবং ‘অন্তর্জলি যাত্রা’র মতো  চলচ্চিত্রের ফলে এক ধারণা জনমানসে বেশ বদ্ধমূল।  তা হলো এক কালের  কুলীন ব্রাহ্মণ মাত্রেই বহুবিবাহ করা লোক।এ কথা সত্য যে কিছু কুলীন ব্রাহ্মণ বহুবিবাহ করতেন – তাদের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ বিশাল সংখ্যায় করতেন এই কদর্য  কাজ।  এ নিয়ে বিতর্ক নেই।  কিন্তু কুলীন ব্রাহ্মণ বলতেই যে একরকম চরিত্র-অঙ্কন তার মধ্যে রয়েছে গোঁজামিল। যে সমাজে কন্যা ভ্রুণ হত্যার সুদীর্ঘ মর্মন্তুদ ইতিহাস রয়েছে এবং বিবাহে জাতের বাছ-বিচারের ফলে নিজের জাতেই বিয়ে হত কুলীন ব্রাহ্মণ-দের, সেই পরিপ্রেক্ষিতে সেক্স রেসিও (অর্থাত জনসংখ্যায়  ১০০০ পুরুষ প্রতি কজন মহিলা) ১০০০-এর কম হওয়াটাই  স্বাভাবিক।  যেখানে অনেক কুলীন ব্রাহ্মণ পুরুষের স্ত্রী জতারি কথা নয় সরল সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে, সেখানে বহুবিবাহের ব্যাপক প্রসার এক কথায় অসম্ভব।  ঠিক যেমন যে কোন সমাজে একই সাথে একধিক স্ত্রী থাকার ব্যাপারটি এক ক্ষুদ্র অংশেরই আচরণ হতে পারে।  অন্যথা হওয়াটা গাণিতিক-ভাবেই দুষ্কর।
কাউকে কেউ অপছন্দ করতেই পারেন, সে মোসলমান হোক, কুলীন ব্রাহ্মণ হোক, শ্বেতাঙ্গ সাহেব হোক। কিন্তু সে ঘৃণার বর্শায়ে বিষ হিসেবে বাস্তব-ভিত্তিহীন প্রচার মাখানো অন্যায় ও পাপ।  ‘লাভ জেহাদ’ নিয়ে যে বিতর্ক, তা এই ধরনের প্রচারের সাম্প্রতিকতম উদাহরণ মাত্র।  বরং প্রশ্ন উঠুক – তথ্য নেই কেন ? সামাজিক বাস্তবতা নিয়ে তথ্যই তো গণ-বিতর্ক-কে শক্তিশালী করে।  অন্যথা চলে ঘৃনা-প্রতিঘৃণার এক প্রাচীন খেলা। প্রশ্ন যখন সংখ্যা নিয়ে, তথ্যই হোক হাতিয়ার। গুজবের মাঞ্জা দিয়ে একে অপরকে ভো-কাট্টা করার অপচেষ্টা বন্ধ হোক।

Leave a comment

Filed under বাংলা, Community, Gender, Religion, Sex

কলকাতার গাজী ইলিয়াস

কলকাতার পথের মধ্যে গল্প থাকে। শীত কাল বলে সে গল্প ভালো করে শোনা যায় – শীতে নিখিল বাংলাদেশে মানুষ একটু কম ঘামে। গল্প চেঁচিয়ে কথা বলে ফাঁকা রাস্তাতেও। তাই অনেক গল্প পথিকের মিস হয়ে যায়। এই তো কদিন আগে আমি ভাগ্যক্রমে এক গল্পের সাক্ষী থাকলাম যেটা কিনা একটু হলেই আড়ালে ঘটে যেত। কলকাতার সেই ছোট গল্পের আগে ঢাকার একটি গল্প দিয়ে একটা  গৌরচন্দ্রিকা করব।
সে ছিল আরেকটি শীতের মরশুম। ২০১০-এর ডিসেম্বরে ঢাকায় লাইভ প্রোগ্রাম করতে এলেন হিন্দী চলচিত্র জগতের জনপ্রিয় নায়ক শারুখ খান, ‘কিং’ খান। হয়তো অনেকেরই মনে আছে। সেদিন শারুখ ছিল স্টেজে।  দাপাদাপি করে সে জনতাকে বিনোদন দিয়েছিল।  এটাই তার পেশা ও কাজ। লাইভ শোতে একটি জনপ্রিয় ক্যারদানি হলো  হঠাত করে দর্শকদের মধ্যে থেকে কাউকে স্টেজে ডাকা। সুপারস্টার ও ভক্ত – এই ব্যাপারটি নিয়ে একটি তাত্ক্ষণিক নাটক মঞ্চস্থ করা আর কি। হঠাত করে ডাক পাওয়া ভক্ত স্টেজে উঠে নায়ক-কে বলবে আপনি মহান, আপনার জন্মদিন-বিয়ের তারিখ-সন্তানের অন্নপ্রাশনের তারিখ সকলই আমার মুখস্থ, কোনদিন-ই আপনার একটি বই-ও মিস করিনি, এখুনো বারবার দেখি বউবাচ্চা নিয়ে, চিরকাল ইচ্ছে ছিল আপনার গা ঘেঁষে একটু দাঁড়াই , আজ সে সুযোগ পেলাম, যেন লটারি-ই জিতলাম আর কি, ইত্যাদি, ইত্যাদি ।  নায়ক-ও ধন্যবাদ জানাবেন, একটু ‘মাটির মানুষ’ বা ‘আমি তোমাদেরই একজন’ গোছের একটু বিনয়, একটু  হাসি ঠাট্টা করবেন আর কি।  এমনই  দস্তুর। সব কিছুরই নাকি একটা ব্যাকরণ আছে অর্থাৎ সকলে তথাকথিত ভাবে ‘সর্বজ্ঞাত’ অনুযায়ী নিজের নিজের ভূমিকা পালন করবে। ‘কিং’-এর শুনবে, আহ্লাদিত হবে, প্রায় পায়ে পড়বে আর এহেন ‘ফ্যান’-এর গ্যাঁজলার গন্ধে  দর্শকেও মত্ত হবে।  প্রোগ্রাম তার ব্যাকরণ মেনে হবে সুপারহিট।
 কপট হয়েই হোক বা অকপট হয়েই হোক, এই ব্যাকরণ যখন লাইভ প্রোগ্রাম-এ কারুর দ্বারা কোন  ভাবে ভঙ্গ হয়, তখন আর এডিট করে ব্যাকরণ-মত করার সুযোগ থাকে না।  বরং ব্যাকরণ  একটি ভান, একটি আস্তরণ, একটি কিম্ভূত নির্মাণ, সেটাই প্রকাশ হয়ে পরে নগ্ন ভাবে। যে পৃথিবীতে কোথায় কেমন ভাবে ঠিক কি করে আচরণ করতে হয়, তা জানা এবং না জানা দিয়ে মানুষের ভাগ্য ও ভবিষ্যত নির্ধারিত হয়, সেই পৃথিবীতে যারা অজান্তে হোক বা জ্ঞানপাপী হয়েও হোক, ব্যাকরণ ভাঙ্গেন, তাদের সাধুবাদ প্রাপ্য। তাই সাধুবাদ দিতেই হয় গাজী ইলিয়াস-কে।  মনে পরে গাজী ইলিয়াস-কে? শাহরুখ খান যখন তাকে স্টেজে ডাকে, সে এসে বলে যে সে বাংলা জানে, দাবি করে যে সে হিন্দী জানেনা। না জানাটাই স্বাভাবিক। ইলিয়াস কিন্তু একরকম চালিয়ে দেবার ইংরেজি জানে। এরপরে সে লম্ফঝম্ফ করা শাহরুখের জন্য রাখা জলের বোতল চেয়ে জল খায়, পিপাসা নিবৃত্তি করতে। তাকে দেখে মনে হয় সে ‘নার্ভাস’, কিন্তু তবুও যখন শাহরুখ বলে যে স্টেজে সকলে দেখছে, ইটা লাইভ প্রোগ্রাম, তাই ‘ঠিক করে’ আচরণ করতে, ঠিক স্টাইলে দাঁড়াতে, তখন ইলিয়াস জানায় যে শাহরুখের স্টাইল এক, আর ইলিয়াসের স্টাইল অন্যরকম।  মঞ্চের কাঠামো অটুট থাকলেও ব্যাকরণ ভেঙ্গে পড়ে।  এর পরে ইলিয়াস আবার বোতল থেকে জল খায়, সবার সামনেই। অনেকের কাছে সে হাসির খোরাক হয়। সে উপযুক্ত ভাবে তার ভূমিকা পালন করতে পারে নি। ইলিয়াস কিন্তু তার নাম ভূমিকা পালন করেছিল সেদিন। গাজী ইলিয়াস ছিল গাজী ইলিয়াস। আর উজ্জ্বল নক্ষত্রের সামনেও গাজী ইলিয়াস থেকে যাওয়ার ফলে শাহরুখ খান-এরই কিছু সময়ের জন্য  করতে হয়েছে, ইলিয়াসকে ধমক দিতে হয়েছে, তারপর ‘ইমেজ’এর স্বার্থে দ্রুত সামলে নিতে হয়েছে। এরই মাঝে এক মেরু-দণ্ডযুক্ত বাঙালিকে শাহরুখ তার বলশালী মারকুটে পাঠান পরিচয় দিয়েছে এক হুমকি-ইয়ার্কির মাধ্যমে। কায়িক বলের এই খেলাচ্ছলে আস্ফালনের জবাব দেয়নি গাজী ইলিয়াস – দিতে পারত। দিলে আরো রসভঙ্গ হত। শাহরুখ খান অভিনেতা।  ইলিয়াস গাজী নার্ভাস কিন্তু অভিনেতা নন।  তার জল পিপাসার ফলে জল খাওয়া শারুখের প্লান-মাফিক মায়া তৈরিকে হঠাত করে রুদ্ধ করেছে।  শারুখের অভিনয়ে গাজী ইলিয়াস সাময়িক যতি চিন্হ এনে দিয়েছে – স্ক্রিপ্ত্হীন নায়ক-কে একটু ঘামিয়েছে। শাহরুখ যে আসল নয়, সে যে অভিনয়, তা ওই সাময়িক যতির কারণে আরো বেশি বেশি প্রকাশ পেয়েছে। প্রকাশ করেছে নার্ভাস গাজী ইলিয়াস।যেখানে যে কথা বললে খাপে খাপ হয়, সেটা না করে বা করতে না জেনে। আমরা গাজী ইলিয়াসকে চিনি।  আমাদের অনেকের মধ্যে সে বাস করে।  আমরা তাকে চেপে রাখি, আমি নিজেদের ভেতরের গাজী ইলিয়াসকে ঘেন্না করি। আমাদের মনের মধ্যে গাজী ইলিয়াস  আছে  বলে আমরা লজ্জা পাই। আমরা নিজেদের ভেতরের গাজী ইলিয়াসকে হত্যা করতে চাই।  আমরা রাস্তার গাজী ইলিয়াসকে নিয়ে নাক সিঁটকোতে চাই , তাকে দুয়ো  দিতে চাই। আমরা আমাদের বাপ-মায়েদের-আত্মীয়-স্বজন-পারা-প্রতিবেশীদের নিচু নজরে দেখি কারণ তাদের অনেকের মধ্যে গাজী ইলিয়াসের সুস্পষ্ট ছাপ।  হয়ত  তারাও নিজেদের অপছন্দ করতে শিখে গেছে। কোথা থেকে আসে এই ছিছিকার, এই নিজেকে লজ্জা করা? আমরা চাই, তারাও চায়, যে তাদের সন্তান যেন দুধে-ভাতে থাকে আর তাদের মধ্যে যেন এক ফোঁটা গাজী ইলিয়াস না থাকে।  তারা যেন স্মার্ট হয়, তারা যেন স্টেজে তুললে পটাপট খাপেখাপ জবাব দিতে পারে।  তাদের দেখে যেন শাহরুখের মাথা একটুও গরম না হয়, একটুও যেন রাগ না চাপতে হয়। যেন শুধুই থাকে ‘সভ্য ব্যাকরণ’ সম্মত হাসি আর আনন্দ। এভাবেই রস গড়াতে থাকে। গড়াতেই  থাকে।
স্থান-কাল-পাত্র বোঝার, তার ব্যাকরণ বোঝার একটা রাজনীতি আছে।  এই রাজনীতির প্রকাশ আচরণে – স্থান-কাল- আচরণে। কিন্তু সে আর নতুন কি? নতুন হলো এই আচরণকে সারাক্ষণ অভ্যাস করে যাওয়া।  এই আচরণকে, এই ভানকে সত্য ও সুন্দর মনে করা। কোন কোন আচরণ? আমি গোদা ভাবে বলতে হলে আমি বলব আমাদের মত কালো মানুষের কল্পনায় শ্বেতাঙ্গ মানুষ যেমন আচরণ করে , তেমন আচরণ। এই আচরণ যে সাফল্যের চাবিকাঠি তা আর কেউ না জানুক,স্পোকেন-ইংলিস সম্রাট সাইফুর স্যার প্রচন্ড ভালো জানেন। এই উপমহাদেশে অন্যের হীনমন্যতা ভাঙ্গিয়ে ব্যবসা করার ঐতিহ্য বেশ পুরাতন। আমরা চাই আমাদের যেন ‘পাতে দেওয়া যায়’। এই পাত কিন্তু কলাপাতা বা শালপাতার না, এমনকি ভূমিজ এলিটের কাঁসার থালা ও না। একেবারে ম্যালামাইন। তাই দরকার পরে চামচ ঠিক করে ধরতে শেখার, আওয়াজ না করে স্যুপ খাওয়ার, এবং আরো হাজারো ‘সভ্য’ ঢং।
ঢং শিক্ষার দুনিয়ায়ে যে অশিক্ষিত, তাকে দেখলেই বোঝা যাবে যে এখুন কোথায় কখন কি করা উচিতের যে বিশ্বজনীন ‘স্বাভাবিক’ সহজপাঠ, তার শিক্ষাগুলি সত্যই শেষ প্রান্ত অবধি পৌঁছয়নি। তাই হঠাত করে আলোকিত করে দেয় অকপট গাজী ইলিয়াস। তাই রক্ষে। আর সে যদি ছুপা রুস্তম কপট হয়?  আমি তাহলে  বলব, সাবাস ইলিয়াস । কত লোকে ক্লিষ্ট ইংরেজি লিখে ভুঁরু ফুটিয়ে সাবভার্সন মারালো, তুমি করে দেখালে।
অথচ কোথায় কেমন করে কি কতক্ষণ করা উচিত – অপিসে, ক্যাফেতে , শ্বেতাঙ্গ পন্ডিতের সামনে, ইংরেজি-কপচানো আমাদের দেশেরই হাপ-পন্ডিতের সামনে, সিনেমা হলে, জলে, স্থলে, অন্তঃরিক্ষে, যারা তার পাঠ বিলোয়ে ‘আধুনিক’ স্বকীয়তার মোড়কে এবং ইলিয়াস্দের প্রবল দুয়ো দেয় ‘অন্কাল্চারড’ হিসেবে – তারাই আবার পরিবার, পারিবারিক আচারআচরণ, বয়স্জ্যেষ্ঠেকে সম্মান, পারিবারিক চেতনা, কোথায় কার সাথে কেমন ভাবে কি আচরণ করতে হয়, বা করতে হয় না,তাকে পদে পদে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ঐযে বিশ্বজনীন ‘স্বাভাবিক’ আচরণের সহজপাঠ, তার প্রথম পাঠ হলো – নিজের সবকিছুকে প্রশ্ন করো, কিন্তু প্রশ্নের উছিলায় তুমি নিজে যে অন্যতর বিশ্বকল্পের দাস হয়ে যাচ্ছো, সে প্রক্রিয়া কে প্রশ্ন করো না। একবার কাছি কেটে দিলেই সহজপাঠের কাজ শেষ, তারপর মানুষ জলে না দবার জন্যই অন্য ডাঙ্গার সন্ধানে জোরে দাঁড় চালাবে, পৌছক আর না পৌছক। এই প্রক্রিয়াটাই খাপে-খাপ। যে ডাঙ্গা থেকে কাছি কেটে আসা হয়েছে, সেখানে ফেরা যাবে না।  সেখানে ইলিয়াস্দের বাস।  ফিরলে সে যদি হাসে? ইলিয়াস্দের উপর হাসা যেতে পারে, কিন্তু ইলিয়াস্দের হাসির পত্র হওয়াটা ঘোর অপমানের। আসলে আমরা আমাদের ক্ষমতাই বুঝি না।  অধিকাংশ ইলিয়াসের মেরুদন্ড আমরা ভেঙ্গে দিয়েছি কবেই। ওই হাড়ের গুঁড়া দিয়েই আমাদের কালো ত্বক সাদা করার পাউডার যোগান হয়। সাদা পাউডার মেখে নিজ সমাজের নরম মাটিতে আমরা নৃসংশ ভাবে আঁচড়ে  দেখাই স্বকীয়তা,  মুক্তিকামিতা, স্বাধীনতা, স্পষ্টবাদিতা , আর কত কি। আসলে যে অন্যকে ‘আন্কাল্চার্ড’ বলে,সে যে ভীষণভাবে সংস্কৃতিক ভাবে নিরক্ষর হতে পারে। বিশেষত দেশ-দশ-সমাজ যদি দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যক্তিস্বাধীনতার অন্তরায় হয়, তখন কাছি কাটাই হয় নবধর্ম। আর ভূমিজ ধর্ম ছেড়ে নবধর্ম ধরলে প্রথম প্রথম যা ঘটার তাই ঘটে – চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসী, চূড়ান্ত পূর্ব-আত্মবিস্মৃতি এবং আত্মসমালোচনার নিদারুণ অভাব। যা কিনা চলতি ক্ষমতার সংস্কৃতি,  হাজার রকম বড় বড় ইংরেজি শব্দ দিয়ে ‘ক্রিটিসিজম’ হবে, মোটা বই হবে।হারেমের স্বেছাবাশিনিরা এবং দ্বাররক্ষীরা কেমনে -বলবে  রাজা তোর  কাপড় কোথায়? রসভঙ্গ করতে লাগবে মানুষ। সে কাজটি করবে অন্য মানুষ। সহজ কিন্তু সরল নয় , এমন মানুষ। এবার ফিরি কলকাতার পথে।
আমি যাচ্ছি বরানগর থেকে হাওড়া স্টেশন, দিল্লীগামী রাজধানী এক্সপ্রেস ধরতে।  আমি ট্যাক্সি করে যাচ্ছি। সাধারনতঃ আমি ট্যাক্সিচালকের নাম, ধাম জিজ্ঞেস করি, কিন্তু সেদিন নানা ব্যাপারে একটু চিন্তার মধ্যে ছিলাম।  তার-ই মধ্যে তারস্বরে চালু হলো এফ এম রেডিও, ট্যাক্সির মধ্যেই লাগানো। এক নারী উপস্থাপিকা সুন্দর গলা করে বললেন, শীত তো এসে পড়ল।  আপনার শীতে কি কি ভালো লাগে? এক ব্যাক্তি উত্তর দিতে শুরু করলো – আওয়াজের ধরণে বুঝলাম ইটা লাইভ টেলিফোন কলের মাধ্যমে কোন শ্রোতা বলছেন।  একজন পুরুষ। সে জানায় যে শীতকাল মানেই বিয়ে ও নানা সামাজিক অনুষ্ঠানের মরশুম। এত অবধি ঠিক-ই ছিল।এত অবধি রাজার, বা ঢপের চলতি বিনোদনের কোন লজ্জাহানি হয়নি। এরপর জল গড়ায় অন্য দিকে।  সে বলে যে শীতকালে তাই মেয়েদের অসুবিধে আর ছেলেদের একটু সুবিধে। অনুষ্ঠানে মেয়েরা সেজেগুজে যায় – শাল জড়ালেও সুন্দর পোশাক আশাক সাজগোজ করতে হয়। কিন্তু ছেলেদের একটা জ্যাকেট বা ফুল হাতা সোয়েটার পরলেই হয়ে যায়ে , নিচে কি পরা, তা ইস্ত্রী করা না কুচ্কোনো, কেমন দেখতে, কিছু এসে যায় না।  পুরনো হলেও এসে যায় না। সুন্দর জামা, সুন্দর দোকান, সুন্দর ক্রেতা ,বিকিকিনি কেন্দ্রিক জীবনকল্পনা, ভালো থাকা কাকে বলে, তার জনসমক্ষে প্রকাশের যে ‘আধুনিক, সুশীল,পাতে দেওয়ার মতো’ ব্যাকরণ, তা টেলিফোন-কারী শ্রোতা লঙ্ঘন করতে শুরু করে।  আমি তখন স্ট্র্যান্ড রোড-এ। বিরল এক মুহূর্ত। উপস্থাপিকা একটু বিষয় বদলাতে চেষ্টা করে কিন্তুপ্রাণবন্ত সচল ডাকসু-তে শুধু সুন্দর গলা দিয়ে অচল করা শক্ত। শ্রোতা থামে না, সে বলে যায়  অবলীলায়, ‘প্লাস ২-৩ দিন কাপড় না  কাচ্লেও শীতকালে গন্ধ কম হয়।  ধরেন চান টান হয়নি তখুন  ভালো করে সেন্ট টেন্ট মেরে জ্যাকেট দিয়েও বিয়েবাড়ি  যাওয়া যায়।  কেউ বুঝতে পারবে না।’ ‘স্টাইলিশ’ ফরফর ইংরেজি-বাংলা মিলমিশ  উপস্থাপিকার গলায় অপ্রস্তুত বেকুব হাসি শুনতে পাই। এর পর বিজ্ঞাপন বিরতি। আর আমার ট্যাক্সি পৌছে গেছে হাওড়া স্টেশন, হাতে কিছুটা সময় নিয়েই। এই ভাবেই, আজকের  সময়ে, কলকাতার পথে যেতে যেতে শুনলাম, যেন আরেক গাজী ইলিয়াসের গলা – ‘রাজা, তোর কাপড় কোথায়?’ কোন এক অজানা কারণে আমার মনে পড়ে  যায় ছাত্রজীবনের স্লোগান ‘তাই তো বলি কমরেড, গড়ে তোল ব্যারিকেড’। ঠাকুর সব দেখছেন, কিন্তু কি ভাবছেন?

Leave a comment

Filed under বাংলা, Bahishkrit Samaj, Bengal, Culture, Elite, Kolkata, The perfumed ones, Urbanity

বাম্বু ও বিষ্ণু

যে জাতি মাতৃভাষার অধিকার ও সম্মান রক্ষা করতে মানভূমে, ঢাকায়, বরাক উপতক্যায় বারবার রাস্তায় নেমেছে, মার খেয়েছে, মৃত্যুবরণ করেছে, এমনকি দেশ স্বাধীন করেছে, সে জাতির মুখের ভাষার প্রশ্ন যে রাজনৈতিক প্রশ্ন হয়ে ওঠে, সে আর আশ্চর্য কি। তবে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক কালের যে বিতর্ক দানা বেঁধেছে মুখ্যমন্ত্রীর মুখের ভাষা নিয়ে, তা ঠিক ভাষার অধিকার নিয়ে নয়, সর্বসমক্ষে শালীনতা বজায় রাখার দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে। সে কথায় একটু পরে আসব। প্রথমেই বলি আমার নিজের কুল-গরিমা নিয়ে। আমার পিতৃকুল হুগলী জেলার পাটুলিগ্রামের অনেক বহুকালের (মানে বহু শতকের) বাসিন্দা এবং এই ‘দেশ’-এর সঙ্গে এই প্রজন্মেও আমাদের সম্পর্ক বেশ গভীর। আমরা রাঢী ব্রাহ্মণ এবং কৌলিন্যপ্রাপ্ত (অর্থাৎ কুলীন)। আমার পূর্বপুরুষেরা বিবাহ-সুত্রে ফুলিয়া মেল প্রাপ্ত হন। অর্থাৎ হিন্দু-প্রধান পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক বিন্যাসে আমরা একদম যাকে বলে টপ-ক্লাস। আমাদের কুলের একজন রায় বাহাদুর ছিলেন, যা কারণে অকারণে (যেমন এখুন) আমরা টুক করে জানিয়ে দিই (ইংরেজিতে যাকে বলে নেমড্রপিং)। এর থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার। তা হলো যাকে কিনা কিছু পন্ডিত এক বিশেষ ধরণের ‘সাবল্টার্ন’ বলেন, এবং আমাদের ‘নিজেদের’ মধ্যে চর্চায় বলি ‘ছোটলোক’ (প্রকাশ্যে বলি অন্ত্যজ, ব্রাত্যজন ইত্যাদি ), আমরা আর যাই হই, তা নই। আমার এই কুলেরই আমার প্রিয় এক জ্ঞাতি জ্যাঠামশাই আমাদের পৈতের পরের বছর দুর্গাপূজার সময় এক সংস্কৃত মন্ত্র শেখান। এটি আচমন মন্ত্র। কোনো অস্ট্রিক ব্যাপার স্যাপার নাই। মন্ত্রটি এরকম – ‘ওঁ বিষ্ণু তদ্‌বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ। দিবীব চক্ষুরাততম্‌।। ওঁ বিষ্ণু ওঁ বিষ্ণু ওঁ বিষ্ণু।’ কুলীন টু কুলীন জ্ঞান ট্রান্সফার হিসেবে আমার রসিক জ্যাঠা ফাজিল ভাইপো-কে এর মানে বলেন। ‘ওঁ বিষ্ণু’ অর্থাৎ একটি বাঁশ , তদ্‌বিষ্ণোঃ অর্থাৎ সেই বাঁশ, পরমং পদং সদা পশ্যন্তি অর্থাৎ পরের পশ্চাতে সদা প্রবেশ করাইবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। বলাই বাহূল্য, আসল মানেটা তাই ছিল না। সেই অর্জিনাল-এ বিষ্ণুর বঙ্গায়ন হয়ে বাঁশ হয় নাই। আমাদের পাটুলিগ্রাম তথা জিরাট-বলাগড় এলাকায় বাঁশঝার বেশ ঘন। তাই হয়তো বিষ্ণু যখন হিন্দুস্তান থেকে বাঁশঝার নিবিড় এই বাংলাদেশে আসেন আমাদের হাত ঘুরে, একটু অদলবদল হয়ে যায় আর কি। ইয়ার্কি মারছি বলে রাখলাম – বিশেষতঃ বোষ্টমদের প্রতি এই ক্ষমাপ্রার্থনা। আমরা শাক্তরা একটু ইয়ে হই। এবার ফিরি রাজনীতি, ভাষা ও শালীনতা প্রসঙ্গে।

পাটুলিগ্রামে যা বাঁশ, লন্ডনে তাই ব্যাম্বু, আর এই দুইয়ের মাঝামাঝি জল্পাইগুড়িতে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাই হয় ‘বাম্বু’। এতে বেশ একটা ‘বিতর্ক’ হয়েছে। এক দল বলছেন, রামঃ, বঙ্গেশ্বরীর মুখের এই ভাষার ছিরি? একদম ‘ঝি-ক্লাস’। কোটি টাকার আঁকিয়ে ও গল্প-কবিতার বই লিখিয়ের আড়ালে এই তাহলে স্বরূপ? আরেকদল বলছেন, আমাদের এই বাংলাদেশের লক্ষলক্ষ মানুষের মুখের ভাষা এরকমই। যিনি জননেত্রী তার ভাষাও যে হবে গণমানুষের মতো, নন্দনে বসে মার্কেজ পড়নেওয়ালাদের মত নয়, তা বলাই বাহূল্য। দুই পক্ষকেই বলি, ভাবের ঘরে চুরি করে কি লাভ? বাম্বু দেওয়ার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়া, প্রবল ভাবে শ্রেণী-ঘৃনা উগরে দেওয়া মুখ্যমন্ত্রীর শব্দচয়নকে সমালচনার উছিলায়, এগুলি ভন্ডামি ও ন্যক্কারজনক। একই সাথে, যারা এমন ভাব করছেন যে কিছুই হয়নি, ভাষা তো ভাষাই, শব্দ তো শব্দই, মানুষে তো এমন করেই কথা বলে গোছের অজুহাত দেখিয়ে বাম্বুর খুঁটি দিয়ে নেত্রীর সাথে জনগনের হৃদয়ের সম্পর্কের গভীরতা মাপছেন, তাদেরকে বলি যে বাংলার গণমানুষকে অপমান করবেন না।

এটা ঠিক যে সব শব্দই সমানভাবে একটি ভাষার সম্পদ – বেশি সম্পদ বা কম সম্পদ নয় । ভাষা জীবন পায় তার ব্যবহারে। সেই ব্যবহারের একটা প্রেক্ষিত আছে। ঠিক যেমন আমরা মাষ্টারমশাই-এর সামনে সিগারেট খাইনা ( যারা উচ্চতর লিবার্টি চেতনার ভারে কুঁজো হয়ে গেছে, তাদের কথা বাদ দিলাম ), ঠিক তেমনই মা-বাপের সামনে কিছু ধরণের শব্দ প্রয়োগ করিনা যা কিনা ইয়ার-বন্ধুদের সাথে চলে। ব্যক্তিগত জীবন ও যাপনকে উলঙ্গ ভাবে মেলে ধরা যাদের জীবনাদর্শ, তারা এই স্থান-কাল-পত্র বুঝে শব্দ প্রয়োগের মধ্যে দ্বিচারিতা দেখতে পারেন। তাদেরকে অনুরোধ, যে ধরনের গণমানুষের কথা বলে বাম্বুর সামনে পর্দা টানা হচ্ছে, সেই রকম ভাষা তারা পথে যেতে-আসতে রোজ ব্যবহার করে দেখুন। গণমানুষ বলবেন ‘মুখ সামলে’। এই গণমানুষ ‘গালমন্দ’ বোঝেন, আবার বোঝেন কারুর মুখের কথা সুন্দর। তাই জনগনের ঘাড়ে বন্দুক রেখে বুলেট বা বাম্বু, কিছুই ছোঁড়া অনুচিত। জলের লাইনে ‘ঝি’-দের ঝগড়ার ভাষা টুকুই যারা শুনেছেন কিন্তু শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা রোজ সক্কাল সক্কাল উঠে কিছুক্ষণের কর্পোরেশনের জলের সাপ্লাই-এর জন্য একাধিক বালতি নিয়ে অপেক্ষা করা যাদের জীবন-যাপনের অংশ নয়, তাদেরকে বলি – এরা গান গায়, ভালবাসে,ঘুম পাড়ানিয়া গান শোনায় শিশুদের। আপনারা যাদের লোকসঙ্গীত বিশ্ববাজারে বেচে খান ও ফান্ড আনান, এরা সেই ‘লোক’। গালি দেওয়া বা বাম্বু দেওয়া, একটিও সহজাত নয়। হয় তা পরিস্থিতির সামনে একটি প্রত্যুত্তর, চরম হতাশার প্রকাশ কিংবা জিঘাংসার উদগিরণ। আমি অবশ্যি কলকাত্তাই সেই ভদ্দরলোক শ্রেণীকে এসব গালি-চরিত থেকে বাদ দিলাম, যাদের কাছে f-ওয়ালা ৪ বর্ণের ইংরেজি গালি হলো কুল (অর্থাত নব্য কৌলিন্যের চিহ্ন) কিন্তু বাংলা গালি হলো চীপ ও ভালগার। তারা অন্য গ্রহের বাসিন্দা। তাদের দূর থেকে প্রণাম।

বাম্বু দেওয়া বা বাম্বুর দ্বারা তাড়া খাওয়া, এ যদি রাজনীতির ভাষা হয়, তাহলে আমি বলব এ ভাষা অশালীন হোক না হোক, চরম হিংস্র তো বটেই। রাজনীতি যখন এলাকা দখল বা এলাকা ধরে রাখার খেলায় পরিনত হয়, সেই প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বাম্বু এক প্রতিশোধমূলক একক। প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিসভার আরেক মন্ত্রী সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতির কুকথার বলেছেন যে নিরঞ্জন গ্রামাঞ্চলের মানুষ। গ্রামাঞ্চলের মানুষ উঠতে বসতে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ান না, বাংলার তৃণমূল স্তরের মানুষ বাম্বুর চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকেন না। তারা চাকরি চান, নিরাপত্তা চান, বাম্বু দিতে চান না, নিতে তো নয়-ই। বাঁশকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংগ্রাম কল্পনা আমাদের বাংলাদেশে বেশ পুরনো। বাঁশেরকেল্লার মধ্যে যতটা ছিল ‘সাবল্টার্ন’ ততটা ছিল হিংস্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদ। প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিসভার আরেক মন্ত্রী সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতির কুকথার সাফাইতে বলেছেন যে নিরঞ্জন গ্রামাঞ্চলের মানুষ। গ্রামাঞ্চলের মানুষ উঠতে বসতে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ান না, বাংলার তৃণমূল স্তরের মানুষ বাম্বুর চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকেন না। তারা চাকরি চান, নিরাপত্তা চান, বাম্বু দিতে চান না, নিতে তো নয়-ই। রাজনৈতিক দল একটি তাঁবুর মত, তা দাঁড় করিয়ে রাখতে বাঁশ লাগে। বাঁশ যেন বাংলার রাজনীতিতে স্থায়ী কাঠামোর কাজ করে, সচল না হয়। নইলে তাঁবু-ও ভেঙ্গে পড়বে। তাঁবুর ব্যাপারীরা বাঁশ সচল করার আগে আশা করি একটু ভাববেন। কারণ ফেইসবুকে সেদিন দেখি এক জায়গায় লেখা , ‘সময় থাকতে পিওর হন,নইলে বাম্বু দেবে জনগণ’।

2 Comments

Filed under বাংলা, Bahishkrit Samaj, Bengal, Caste, Elite, Kolkata, Language, Polity, Power

ম্যাড্রাসী কারে কয়?

 

ইউটিউবে একটি ভিডিও সর্দি-কাশির ভাইরাসের মত ছড়িয়ে পড়েছে। নাম ‘এন্না দা রাস্কালাস – সাউথ অফ ইন্ডিয়া’। বেশ চনমনে ও মজাদার এই ভিডিও ইতিমধ্যে প্রায় ১৪ লক্ষ বার দেখা হয়েছে মাত্র ২ সপ্তাহে । না দেখে থাকলে দেখে ফেলুন। স্ট্রে ফ্যাক্টরি ও কালচার মেশিন নামের দুই শিল্পীগোষ্ঠী ‘দক্ষিন ভারত’-এর বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র ও পৃথক সংস্কৃতি ও জীবনবৈশিষ্ট-কে তুলে ধরেছেন। ‘মাদ্রাজী’ নাম এক করে দেখা এবং হেয় করার প্রবণতার বিরুধ্যে এই ভিডিও। ‘দেয়ার ইজ নো ম্যাড্রাসী, উই আর অল পারোসি’ ( ম্যাড্রাসী বলে কিছুই নেই, আমরা সকলে প্রতিবেশী) – এই হলো গানের জনপ্রিয় লাইন ও মূলমন্ত্র।

এবেলা স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে ম্যাড্রাসী শব্দটা আমি বাঙ্গালীদের সঙ্গে কথোপকথনে ব্যবহার করে থাকি। এ শব্দটি শুনেই বড় হয়েছি। আসলে, বাংলায়ে ম্যাড্রাসীর সাথে মাদ্রাজী শব্দটিও চালু আছে – রোজকার কথায় এবং সাহিত্যেও, প্রথম হিন্দী ফিলিম হবার অনেক আগে থেকে। নিখিল বাংলাদেশে সাধারণত এই শব্দটি কাউকে নিচু করে দেখাতে ব্যবহার করা হয় বলে মনে হয়নি। আমি গঙ্গা-যমুনার হিন্দুস্তানী এলাকায় বড় হইনি। শুনেছি সেখানে নাকি ম্যাড্রাসী শব্দটি বেশ হেয় করেই ব্যবহার করা হয়। আমার বাংলার ‘মাদ্রাজী ‘ শব্দ, যার মাধ্যমে আমি অন্য বাঙ্গালীর সাথে একটা সাধারণ-ভাবে জানা ধারণাকেই নির্দেশ করি। যদিও এটি মোটামুটি নানান দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠির (যেমন তামিল, তেলুগু, ইত্যাদি) জাতীয়তাগুলিকে বোঝাতে ব্যবহার হয়, সচেতনভাবে তাদের মধ্যেকার তফাত্গুলিকে মোছার লক্ষ্যে ‘মাদ্রাজী’ শব্দের উত্পত্তি নয়। দ্রাবিড় জাতীয়তাগুলির মধ্যের বাস্তব ভিন্নতা নিয়ে আসলে আমাদের মাথাব্যথা ছিল না। বরং এই বাংলাদেশে আমরা যে সব দ্রাবিড় জাতীয়তাগুলির মানুষের সংস্পর্শে এসেছি, তার ভিত্তিতে বানিয়ে নিয়েছি এক ‘মাদ্রাজি’ – যার আকার ও বৈশিষ্ট একান্তই আমাদের নিজস্ব দ্যাখা-শোনার ভিত্তিতে। বাংলাদেশের মনের একটি জায়গায় বাস করে আমাদের এই ধারণার ‘মাদ্রাজী’, কিছুটা বাঙ্গালীর ‘ব্রেজিল-আর্জেন্টিনা’র মত – আগমার্কা আসলের সাথে যার মিল খুজতে গেলে আমাদের নিজেদের গড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াকে এবং সে প্রক্রিয়ার সততাকে অস্বীকার করতে হয়। ঔপনিবেশিক সময়ে নিখিল বাংলাদেশের শহুরে মানুষের অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ফল যে মাদ্রাজী, দক্ষিণের নানান জনগোষ্টির সাথে তার সম্পর্কে দূরের , যদিও পুরো সম্পর্কহীন-ও নয়।

এই উপমহাদেশের দক্ষিন অংশে রয়েছে নানান দ্রাবিড় জাতীয়তাগুলির নিজনিজ মাতৃভূমি। এই এলাকাগুলির একটা বড় অংশ ইংরেজরা ‘ম্যাড্রাস প্রেসিডেন্সি’ নাম দিয়ে এক প্রশাসনের ছত্রতলে নিয়ে আসে। এই সময়েই নানান ভৌগলিক ও জাতিগোষ্টির এলাকা তালগোল পাকিয়ে ‘মাদ্রাজ’ নামক নির্মিত ধারণার উদ্ভব ঘটে। নির্মিত কারণ সাহেবরা এক প্রশাসনের তলায় এনে মানচিত্রে দাগ কেটে দেওয়ার ফলেই ‘মাদ্রাজ’ ব্যাপারটি চালু হয়, ক্রমে হয়ে ওঠে ‘আসল’ কিছুটা। ঠিক এই ঔপনিবেশিক সময়েই, প্রশাসনিক একতা ও মানচিত্রে সাহেবের টানা দাগের ভিত্তিতে আরেকটা ধারণার বাজার আস্তে আস্তে গরম হতে থাকে। সে ধারণাটির নাম ‘ইন্ডিয়া’। যে ধারণাগুলির পেছনে ঠেকা হিসেবে থাকে বন্দুক ও লস্কর, তার নাম হয় জাতিরাষ্ট্র। আর যেগুলির থাকে না, তা থেকে যায় জাতীয়তা হিসেবে।

দেশভাগের পরে রাজ্যগুলির ভাষাভিত্তিক পুনর্গঠন এবং শহরের পুনর্নাম্করণের ফলে ‘মাদ্রাজ’ মোটামুটি অবলুপ্ত হয়েছে। ‘ইন্ডিয়া’ ধারণাটি নানাভাবে বিভক্ত হয়েছে – এক পবিত্র মাতৃভূমি (ভারত নামধারী সংঘ-রাষ্ট্রে), শক্তিশালী ষড়যন্ত্রকারী শত্রু (পাকিস্তানে), দাদাগিরি দেখানো ‘বন্ধু’ (৭১ পরবর্তী পূর্ব্ববঙ্গ অর্থাত গনপ্রজান্তন্ত্রী বাংলাদেশে), এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী (বর্মায়), ইত্যাদি। অনেক উপনিবেশ এলাকাতেই ‘মাদ্রাজ’ বা ‘ইন্ডিয়া’ গোছের ধারণাগুলি গল্পটা একইরকম। একই প্রশাসনের তলায়ে বসবাসকারী নানান জাতীয়তার মানুষ , বিশেষতঃ শহুরে পেশাজীবী ও শ্রমিকেরা, অন্যান্য এলাকার শহরে পৌছয়ে। এই আদানপ্রদানের মাধ্যমে এবং সাহেব বিরুদ্ধতাকে কেন্দ্র করে একটা সাধারণ ঐক্যের ধারণা তৈরী হয় – যা ক্রমে জাতিরাষ্ট্রের হিসেবে বাঁধে। এই ধরনে ধারণা কাল্পনিক বলেই ঐক্য, অখন্ডতা, পতাকা স্যালুট, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পশু, এক সংসদ, এক প্রশাসনিক ক্যাডার (আইএএস, আইপিএস), কেন্দ্রীয় সিলেবাস, শিক্ষা বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি নানা ব্যবস্থার মাধ্যমে এই কল্পনাকে বাস্তবের রং দিতে হয়, মন্ত্রের মত বলে যেতে হয় এই ধারণার পবিত্রতার কথা। আবার একই সাথে ধারালো অস্ত্রে সান দিতে হয় সারাক্ষণ – এই গানের সুরে যারা গলা মেলায় না, তাদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য। এইখানে ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের আশ্চর্য মিল। তা গুমখুন হওয়া বেলুচি-সিন্ধি-মণিপুরী-নাগারা হাড়েহাড়ে জানেন।

‘ইন্ডিয়া’র অন্তর্গত জাতীয়গোষ্ঠির্গুলিকে কেন্দ্র যে এক চোখে দ্যাখে না, সেটা কারো অজানা নয়। কাল্পনিক ‘ইন্ডিয়া’র ”আসল’ আত্মাটি যে বিন্ধ্য পর্বতমালার উত্তরে হিন্দুস্থানী এলাকায়, তা আর বলতে অপেক্ষা রাখে না। বলিউডিয় ‘আম আদমি’ যে পূর্বের বা দক্ষিণের আদমি নন, সেটা পরিষ্কার নিশ্চই পরিষ্কার হয় এশিয়াড বা অলিম্পিকে ‘ইন্ডিয়া’ দলের ‘আসল’ পাগড়ি দেখে – সে মাথা তামিল হোক বা উড়িয়া। পাগড়ি হলো মেনস্ট্রিম। বাকিদের কষ্ট করে বোঝাতে হয় তারা কারা, কি খায়, কি গায়, কি করে, কি পরে, কি বলে, ইত্যাদি। যেমন পুষ্প-প্রদর্শনীতে অজানা গাছের নাম ছোট করে লেখা থাকে , তেমনই আর কি। ‘সাউথ অফ ইন্ডিয়া’ ভিডিওর মূলে রয়েছে ‘আসলি’ ইন্ডিয়ানদের কাছে নিজেদেরকে তুলে ধরার, বুঝিয়ে বলার প্রচেষ্টা। যাতে তাদেরকে একইভাবে স্টিরিওটাইপ না করা হয়। ‘ইন্ডিয়া’র দিল যে দিল্লীতে , একের পর এক নাগা, মিজো , মণিপুরী হত্যা, ধর্ষণ, প্রহার, অপমানের ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় যে সব স্টিরিওটাইপ বাঙ্গালীর ‘মাদ্রাজির’ মত অপেক্ষাকৃত নিষ্পাপ নয়। হিন্দী বচন, গুরগাঁও গমন, দেওয়ালি পালন – এগুলিই ‘ইন্ডিয়া’র আত্মা থেকে দুরে থাকা জনগষ্টিগুলির ‘ইন্ডিয়ান’ হবার সোপান। কিন্তু আমাদের নিজনিজ মাতৃদুগ্ধ-মাতৃভাষা-মাতৃভূমি তো কাল্পনিক নয়। উপমহাদেশের অনেকে ‘ইন্ডিয়ান’ বলতে যাকে কল্পনা করেন, তাদের সাথে অনেক ‘ইন্ডিয়ান’এরই কোন মিল নেই। তারা যদি আজ মাইল গান গায় , ‘দেয়ার ইজ নো ইন্ডিয়ান, উই আর অল পারোসি’ – তারা কি খুব ভুল বলবে? ‘ম্যাড্রাসী’ নামের ধারণাকে যদি বেশি তলিয়ে মারো টান, আরো অনেক পবিত্র কল্পনাও হয় খানখান। তাই, ‘ওপারে যেও না ভাই, ফটিংটিং-এর ভয়’। দিনকাল ভালো না।

2 Comments

Filed under বাংলা, Bengal, Colony, Foundational myths, Hindustan, India, Nation, Pakistan

কলকাতার কাশ্মীর

[ Doinik Arthokotha (Dhaka), Nov 2014]

কয়েকদিন আগে দিল্লীর একটি মেগাজিনে একটা লেখা দেখলাম। শিরোনাম ‘কলকাতা আফটার ক্যালক্যাটা’। নামটি বেশ ব্যঞ্জনাময়।  এই লেখা তাদের জন্য, যাদের জন্য ক্যালক্যাটা ছিল সুন্দর, তার পরে তা যখন কলকাতায়ে পরিণত হলো,  তখন শহরের জাত গেল, সম্মান গেল, সেই ‘চার্ম’-টা আর রইলো না। এ শহরের একটা বড় অংশ কিন্তু কখুনই কলকাতা থেকে ক্যালকাটায়ে সে অর্থে প্রবেশ করেনি ফেরিওয়ালা বা ভৃত্য হিসেবে ছাড়া।  তাদের জন্য কোনো ‘কলকাতা আফটার ক্যালক্যাটা’ নেই।  রয়েছে কলকাতার নিরবিছিন্নতা। ক্যালক্যাটা পরিযায়ী পাখিদের শহর।  তারা অনেকে আজ উড়ে গেছে ব্যাঙ্গালোর, বোম্বেতে । যদিও সেখানেও বেঙ্গালুরু বা মুম্বই-এর সাথে তাদের যোগ ক্ষীণ।  ঠিক যেমন কলকাতায়ে অবস্থান-কালীন সময়ে এই ক্যালক্যাটা কোনো ক্রমে কলকাতা-কে বাঁচিয়ে চলত। কলকাতার পরিসর থেকে ক্যালক্যাটার স্বেচ্ছা-নির্বাসনে কলকাতার খুব তফাৎ হয়নি।  কলকাতা নিজের  মধ্যে যাযা ধারণ করে, তা ক্যালক্যাটার ধারণার অতীত। এমনকি এক কলকাতা হলো কলকাতার কাশ্মীর।

বলাই বাহুল্য এই কাশ্মীরের সাথে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের ‘কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী’ হুঙ্কারের কাশ্মীরের মিল নেই।  প্রায় সকল কাশ্মীর-ই আমাদের মনে মনে বানিয়ে নেওয়া। প্রায় সকল বললাম কারণ কাশ্মীরিদের-ও একটা কাশ্মীর আছে , যেটা এই নানা কাশ্মীরের মাঝে হারিয়ে যায়। ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া’র হুঙ্কারে , স্লোগানে বাস্তবের টেকনাফ বা তেঁতুলিয়া বড় প্রান্তিক।  উচ্চ্চারিত অক্ষরের মিল ঘটিয়ে স্লোগান বলশালী ও ছন্দময় হয়, কিন্তু টেকনাফ ও তেঁতুলিয়ার সাথে ঢাকার দূরত্ব একই থেকে যায়। প্রসঙ্গত, পশ্চিম বাংলাতেও একাধিক তেঁতুলিয়া নামধারী জায়গা আছে। তবে এখুন সেটা থাক।ফিরি কাশ্মীরে , কলকাতার কাশ্মীরে।

আমার কর্মস্থল আমার ঘর থেকে বেশ খানিকটা দূরে।  আমি থাকি কলকাতা শহরের দক্ষিণ দিকে, চেতলা অঞ্চলে।  এলাকাটি শহর কলকাতার থেকে পুরনো – তখন নাম ছিল জেলেপাড়া। এখুনো এই জেলেপাড়া নাম ও পরিচয় সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়নি। জেলেপাড়া থেকে আজকের চেতলায়ে  এলাকার  বিবর্তন-ও এক অসামান্য গল্প, যা আরেকদিন বলব । তো রোজ-ই চেতলা থেকে আমি যাই বরানগর। এটি কলকাতা ছাড়িয়ে উত্তরে একটি ছোট শহর। আমি কলকাতার ভূগর্ভস্থ মেট্রো-রেলে চড়ে পৌছই শ্যামবাজার – একটি  বিশাল, বর্ণময়, জনবহুল, সদাব্যস্ত বাজার এলাকা – তাঁতের শাড়ি থেকে ভাং-এর মিষ্টি, সবই পাওয়া যায়। এখানেই ৫টি রাস্তা এসে মিশেছে – তাই নাম ৫ মাথার মোড়। কেন্দ্রস্থলে রয়েছে সুভাষ চন্দ্র বসুর মূর্তি, ঘোড়ায় চড়া, সমর-সজ্জায়। ঘোড়ার উন্নত ল্যাজ যে দিকে নির্দেশ করে, সেদিক ধরে আমি এগিয়ে একদিন পৌছলাম এক তেলে ভাজার  দোকানে। সবই সুলভ মূল্যের – একটু বেশীই সুলভ যা কিনা আমার মতো সবর্ণ ভদ্রলোক স্বচ্ছল মানুষের মনে খাবারের গুণমান সম্পর্কে সন্দেহ জাগায়। সঙ্গের ছবিতে দিলাম মূল্য তালিকা। জিনিসগুলি প্রায় সবই বেশ চেনা – আলুর চপ, বেগুনী, কচুরী, সিঙ্গাড়া, ধোকা ইত্যাদি। চোখ আটকালো কাশ্মিরী চপ-এ গিয়ে।  এ আবার কি জিনিস? জিজ্ঞেস করলাম দোকানিকে।  ততক্ষণে আমার হাতে কাগজের ঠোঙায় ইতিমধ্যেই একটা ভাজা ধোকা রয়েছে। দোকানি বলল, খেয়ে দেখতে পারেন একটা।  আমি নেবার আগে জিজ্ঞেস করলাম কেমন খেতে? দোকানি  বলল খেয়েই দেখুন না – মাত্র ৩টে টাকাই তো দাম। তারপর বলল, একটু টক-ঝাল-মিষ্টি। ৩
টাকার কাশ্মীরি চপ কেনার আগে অজানা স্বাদ নিয়ে ঠকে যাবার ব্যাপারে সজাগ এই ক্রেতা (অর্থাৎ আমি) যে কতবার দামি খাবারের হোটেলে গিয়ে নাম না জানা ভিনদেশী খাবার নিয়ে ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করেছে। স্থান, কাল, পত্র দেখে আমার পরীক্ষা কমে, নিরীক্ষা বাড়ে। স্বচ্ছল মানুষের ব্যক্তিগত দুনম্বরীর নানা অব্যক্ত বিভঙ্গ আছে, এটি তার একটি। আজ তার-ই মধ্যে একটা বাজারে প্রকাশ করে দিলাম। সে যাই হোক, নিলাম একটা কাশ্মীরি চপ।  বাইরে থেকে দেখতে ভেজিটেবিল চপের থেকে আলাদা নয়, ভেতরেও বিশেষ তফাৎ নেই।  তফাৎ-টা স্বাদে। সত্যই টক-মিষ্টি, ঝাল প্রায় নেই। উদরস্থ করলাম দ্রুত। ভাই, এটাকে কাশ্মীরি চপ কেন বলা হয় ? সে বলল, কাশ্মীরে খায়টায় বোধহয়, ঠিক জানিনা। তবে অনেকদিনের আইটেম। আমারও এই ‘কাশ্মীরে খায়টায়’ ব্যাপারটি ঠিক বিশ্বাস হলো না।  তাতে কি। নিখিল বাংলাদেশে, কলকাতায়, ঢাকায়, টেকনাফ থেকে হাসিমারা, দীঘা থেকে বিয়ানীবাজার ফুটবলকে কেন্দ্র করে যে ব্রেজিল-আর্জেন্টিনা মত্ততা, তা একান্তই আমাদের, ব্রেজিল-আর্জেন্টিনা তার খবর জানে না, রাখেও না।  তাতে আমাদের ভারী বয়েই যায়। আমি নিশ্চিত আরো এমন ছোট দোকানে ‘কাশ্মীর’ বেঁচে আছে।  কলকাতার এই কাশ্মীরি ঐতিহ্য একান্তই তার নিজের। এবং খাঁটি। এর ভাষা ও ভাষ্য, পোড়া নিকৃষ্ট তেল, বদহজম, ঘাম, টক-ঝাল-মিষ্টি আমাদের। এই কাশ্মীরের তারিফ করতে গেলে শ্বেতাঙ্গ পন্ডিতের মতামত ধার করতে হয় না, যেমন করতে হয় শ্বেতাঙ্গ মানসিকতার কালা আদমির ইংরেজি রচনার ক্ষেত্রে। সায়েব পিঠ চাপড়ে সাবাস না বললে কালা আদমির ইংরেজি রচনা থেকে যায় অক্ষম। কলকাতার এই কাশ্মীর চর্চার জন্য শারীরিক বা মানসিক শ্বেতাঙ্গের দ্বারা পিঠ চাপড়ানোর দরকার পড়ে না। শ্বেতাঙ্গ দৃষ্টির শ্বেতাঙ্গ মননের সীমাবদ্ধতা বিশাল। সে জানেই না আমাদের পিঠ কোথায় আর পেট কোথায়। তাই অনেক মরেও বাংলা বেঁচে গেছে। ঠাকুর মঙ্গলময়।

এই শহর কলকাতায় আমি আরো কাশ্মীর দেখেছি। যখন আমি কলেজ স্ট্রিটস্থ মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তাম, তখন মাঝে সাঝেই যেতাম কলুটোলা স্ট্রিট ধরে চিত্তরঞ্জন এভিনিউর ওপারে, মৌলানা সৌকত আলী স্ট্রিটে। সেখান থেকে বেরিয়েছে এক অবিস্মরণীয় ছোট গলি – নাম ফিয়ার্স লেন। ফিয়ার্স লেন-এর নানা মহিমা নয় আরেকদিন বলব, আজ আসি এখানকার সুতা কাবাবের দোকানের সামনে। এখানকার অসম্ভব স্বস্বাদু শাল-পাতায় পরিবেশিত কাবাব আমি খেয়েছি অনেকবার।  একদিন দেখি উল্টোদিকে বসেছেন আরেকজন – সাদা জামা-কাপড়, টুপি-দাঁড়ি, সামনে একটা ডেকচি, আর পাশে লেখা ‘কাশ্মীরি কাবাব’। গিয়ে খেলাম।   যা পেলাম, তা হলো দুপিস ছোট বান-রুটির মধ্যে হলুদ রঙের থকথকে মশলাদার কাই-তে মাংসের কিমা।  অর্থাৎ এই সে অর্থে ‘কাবাব’ নয়। জিজ্ঞেস করলাম, উনি কে, কবে থেকে বসছেন ( আমি তো প্রায়-ই যেতাম ওখানে, আগে দেখিনি), কাশ্মীরি ব্যাপারটা কি, ইত্যাদি। জানলাম ওরা ৩ পুরুষ কলকাতায়, এরা হিন্দুস্থানী – সেখান থেকেই এখানে আসা কিন্তু কাশ্মীর থেকে কিনা বলতে পারেন না, জানবাজারে একটা ঘড়ি সারাই-এর দোকান ছিল বা আছে কিন্তু তা ভালো চলছে না, নতুন ব্যবসা শুরু করে আয়ের চেষ্টা করছেন। আর কাশ্মীর ? ওটা এমনিই লিখেছেন।  কদিন বাদে ওনাকে আর দেখিনি – হয়ত কাশ্মীরি কাবাব ব্যবসা চলেনি, হয়ত ঘড়ি সারাই-তে ফের একটা চেষ্টা করছেন, হয়ত অন্য কোথাও কাশ্মীরি কাবাব বেচছেন, যেখানে উল্টোদিকেই এমন সফল কাবাব দোকান নেই। যদি কাশ্মীরি কাবাব ব্যবসা সফল হত, এর ৩-৪ পুরুষ পরে এক খাঁটি ‘কাশ্মীরি’
আইটেমটিকে , পরিবারটির আদি কাশ্মীরি বংশপরম্পরা ও আরো নানা প্রবাদ তৈরী হত। সেটা হয়নি।  গড়ার সাথে সাথেই ভেঙ্গে গেছে হয়তো। কিন্তু যেগুলি ভাঙ্গেনি, এমনই অনেক খাঁটি ‘কাশ্মীর’ , এমনই অনেক খাঁটি ‘বঙ্গীয়’ ব্যাপার-স্যাপার লুকিয়ে আছে আমাদের মাঝে, আমাদের অস্থিমজ্জায় , আমাদের আত্মপরিচয়ে, বাঙ্গালিত্বে।

Leave a comment

Filed under বাংলা, Bengal, Kolkata, Urbanity

বঙ্গদর্শন

[ Ebela, 4 Nov 2014]
খণ্ডিত বঙ্গের দুই অংশ – ছোট ভাই পশ্চিমবঙ্গ ও বড় ভাই পূর্ব্ববঙ্গ।  এই দুই বঙ্গ মিলেই আবহমানকালের বাংলাদেশ – যদিও ১৯৭১-এর পর তা মূলতঃ পূর্ব্ববঙ্গের জাতিরাষ্ট্রের
‘অফিসিয়াল’ নামে পরিণত হয়েছে। নিজেকে বাংলাদেশ নামে ডাকার অধিকার পশ্চিমবঙ্গের বড় অংশই ছেড়ে দিয়েছে। সেটা দুঃখজনক। নিজের নাম স্বেচ্ছায় কেন কেউ নিজে থেকেই ভুলে যাবে, তা আমার বোধগম্য নয়। তো সে যাই হোক, এতটাই আত্মবিস্মৃত আমরা যে বাংলাদেশ নামটির পুরো অধিকারটাই আমরা তুলে দিয়েছি পূর্ব্ববঙ্গের হাতে। খন্ড-বঙ্গের ছোট খন্ড আমরা।  এই খন্ড ভাব আর ছোট ভাব দুটি প্রায় হারাতে বসেছে আজ দিল্লীর তালে নাচতে গিয়ে। তাই তো আজ পশ্চিমবঙ্গের অধঃপতিত জাতি নাক সিঁটকে বলতে শিখেছে ‘ওরা তো বাংলাদেশি’। আর তোরা হলি ‘ইন্ডিয়ান’। বাঙ্গালী তাহলে বোধহয় বঙ্গোপসাগরের গভীরে বসে মাঝে মাঝে মুণ্ডু তুলে কলকাতার ডাঙ্গা দেখছে – কেকেআর, শাহরুখের নাচ, আটলেটিকো, দিওয়ালি, হোলি, গুরগাঁও তথা আরো হরেক বেঙ্গলী ব্যাপার-স্যাপার। এরই মাঝে বোমা ফাটল বর্ধমানে। আরেক রকমের বেঙ্গলী সকলের টিভিতে এসে উপস্থিত। বাংলাদেশী ! এবার আর গরু-পাচারকারী বা কাঁটাতার পেরোনো বেআইনি হিসেবে নয়। পরিচয় এবার জেহাদি। খবরে তেমনই প্রকাশ।
অথচ চিরকাল ব্যাপারটা এমন ছিল না। পশ্চিমবঙ্গ বুঝত ও জানত যে ‘ওপারে’ যে দেশটি, তার সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক। সে সম্পর্কের স্বীকৃতি কোনো আইন বা সংবিধান দেয় না। তাতে কি বা এসে যায়? এসে যায়নি বলেই তো ১৯৭১-এ পূর্ববঙ্গের মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিমবঙ্গে  যে বিশেষ সংহতির উন্মাদনা দেখা গেছিল, তাতে অনেক ঐক্য ও অখন্ডতার পূজারীরা ভয়ানক জুজু দেখেছিল। যখন স্লোগান উঠেছিল – এপার বাংলা, অপার বাংলা, জয় বাংলা, জয় বাংলা – তখন অশোকস্তম্ভের ৪ সিংহের ভুরু কুঁচকে গেছিল। পূর্ব্ববঙ্গের এক নকশালপন্থী (হ্যা, ওদিকেও ছিল ও আছে) দল -এর স্লোগানে ছিল অন্যতর কল্পনার বীজ – দুই বাংলার চেকপোস্ট উড়িয়ে দাও, গুঁড়িয়ে দাও। সে  বীজ থেকে যে কোনো চারাগাছ বেরোয়নি আজ অবধি, তা বলাই বাহুল্য। যে কোন দাবি বা স্লোগান একটি বিশেষ সময়ের দলিল। আজ এই স্লোগান উঠলে অবশ্যই শুনতে পাব – চেকপোস্ট উড়িয়ে মরি আর কি। এমনিতেই বিএসএফ দিয়ে ওদের পিলপিল করে আশা রোখা যাচ্ছে না, উড়িয়ে দিলে তো পশ্চিমবঙ্গ-টাই দখল করে নেবে।  ন্যায্য চিন্তা, বিশেষতঃ যখন ১৯৭১-এর পরেও পূর্ব্ববঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর
নির্যাতন, সম্পত্তিদখল, দাঙ্গা ইত্যাদি চলেছে প্রায় নিরন্তর – সরকারী/বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতায়। আর হিন্দুদের পূর্ববঙ্গ থেকে পালিয়ে আসাও চলেছে নিরন্তর।  চলছে আজ-ও। তবে তারা নিম্নবর্গের, তারা ব্রাহ্ম্মন-কায়স্থ-বৈদ্য নয়, তাই তাদের আখ্যান পশ্চিমবঙ্গে উপেক্ষিত। তার উপর আছে এক ধরনের মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার। ১৯৭১-এর সংহতি থেকে আজকের পূর্ব্ববঙ্গের বাস্তব চিত্র সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞানহীনতা, ইটা ঘটল কি করে? কি করে পশ্চিমবঙ্গ তার ওপর অংশ কে দেখার বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি হারিয়ে ফেলল?  কেন আজ তাকে দিল্লীর থেকে চোখ, ক্রাচ আর দূরবীন ধার করে পুর্ব্ববঙ্গকে দেখতে হয়। কখন আমরা অন্ধ, অশিক্ষিত ও পঙ্গু হয়ে গেলাম? কখন আমরা ‘বৈরী বাংলাদেশী’ নামক চরিত্রের নির্মাণের দিল্লী রেজিমেন্টে নাম লেখালাম?
আজকে বর্ধমানের কল্যাণে আমরা জেনেছি জামাত-এ-ইসলামীর নাম। এর আগের গল্প কেন আমরা এত কম জানি? আসলে আমরা তো ক্রমে পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলিরও নাম ভুলতে শিখেছি, ওপারের খবর কি জানব। বরং দিল্লি-বম্বে-গুরগাঁও-নয়ডার মানচিত্র মুখস্থ করি গিয়ে। সচিন মোদের  ব্রহ্মা, শাহরুখ মোদের বিষ্ণু আর দিল্লীশ্বর হলেন সাক্ষাত মহেশ্বর। মন্দিরে আর জায়গা কই ? কার সন্তান কত অন্যাশে বঙ্গ-ত্যাগ করে দিল্লী-বোম্বাই পৌছেছে, এই যাদের সাফল্যের মাপকাঠি, তারাই ক্ষুব্ধ হয় বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গে। অনুপ্রবেশ অবশ্যই সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণ হিসেবে দেখা দিতে পারে, কিন্তু বলবে কারা – যারা পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করে উন্মুখ, তারা ? বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপক অংশ জেহাদ করতে কাঁটাতার পেরোন না, আসেন জীবিকার জন্য। দুবাই বা মালয়শিয়া পাথেয় যোগার করতে পারলে এদিকে আসতেন-ও না। ঠিক যেমন আমলাশোল থেকে ঢাকা যাবার সহজ ব্যবস্থা থাকলে অনাহারে মরার থেকে অনেকেই গার্মেন্ট কারখানায় কাজ করতে বেশি পছন্দ করতেন।
ক্ষুদ্রতর পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসেবে বৃহত্তর পূর্ব্ববঙ্গকে বোঝার দায় আমাদের আছে। আজকের পুর্ব্ববঙ্গকে। কবেকার ফেলে আসা ভিটেকে খোঁজা না , সেই ভিটেতে যে ব্যাপক বদল ঘটেছে – সেটাকে বোঝা। আমাদের জানতেই হবে যে শিশু ফালানি খাতুনের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ কেন কাঁটাতারে ঝুলছিল, জানতেই হবে কোন সীমান্তরক্ষী তাকে খুন করলো – তবে জানতে পারব এই পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সীমান্তরক্ষীদের দৈনিক অত্যাচারের কথা।ওদিকের সীমান্ত রক্কাহ করে বাঙ্গালী। স্থানীয় মানুষের মুখের ভাষা বোঝে।  এদিকের কথা আর বললাম না। মার্কিন দূতাবাসের সামনের রাস্তার নাম হোচিমিনের নামাঙ্কিত করে যে দুঃসাহস ও ঘৃণা জানিয়েছিল কলকাতা, সেই দায়তেই জানতে হবে কেন ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসের সামনের রাস্তা ফেলানির নামাঙ্কিত করার দাবি ওঠে।  জানতে হবে ওদিকের সুন্দরবনের রামপালে ভারতের এনটিপিসি-র পরিবেশ ধ্বংসকারী বিদ্যুত প্রকল্পে পশ্চিমবঙ্গবাসী দায়হীন কিনা। জানতে হবে সব সাইক্লোন শেষ মুহুর্তে আমাদের কাটিয়ে যখন ওদিকে ঘুরে যায়,তারপর কি হয়? তার জন্য পরের ছুটিতে হিমাচল-কন্তাকুমারি-রাজস্থান-আন্দামান না করে একটু যান-না ওদিকে।
এক শ্রেনীর পশ্চিমবঙ্গীয় ওদিক ঘুরে এসে এক রোমান্টিক স্বর্গের চিত্র আঁকেন। ঢাকায় দুর্গাপুজো দেখে বলেন, সব ঠিক-ই আছে। ফি বছর যে বেশ কিছু দুর্গাপ্রতিমা আক্রান্ত হয় ওদিকে, সেটা বলতে কুন্ঠা কেন? ওদিকের সংবিধানের আগেই রয়েছে একেশ্বরবাদী ইসলামী বাণী।  এদিকে মা দূর্গা সহায় বা জয় শ্রী রাম নেই। এদিকে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তিলুঠ হচ্ছে, দেশত্যাগে
বাধ্য করা হচ্ছে, একথা নিন্দুকেও বলতে পারবেন না। এ প্রসঙ্গে ওদিকের লজ্জিত হওয়া উচিত। অতীতের হিন্দু জমিদারের অত্যাচারের শাক দিয়ে আজকের বাস্তবতার মাছ ঢাকা যায়না। আবার ওদিকেই শাহবাগে ৭১-এর চেতনাধারী মূলতঃ মোসলমান বিশাল যুবসমাবেশে ডাক ওঠে ‘সূর্য্য সেনের বাংলায়, জামাত-শিবিরের ঠাই নাই’। সূর্য্য সেনের জন্মদিন উপলক্ষ্যে  ওদিকের খবরের কাগজে একটি ব্যাঙ্কের পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন দেখেছি – এদিক কল্পনা করতে পারে?
শরতচন্দ্র বাঙ্গালী ও মোসলমানের মধ্যে ফুটবল খেলিয়ে অনেক গাল খেয়েছেন। আজ কলকাতা নামধারী ফুটবল-দলের সাথে ঢাকা মহমেডান ক্লাবের খেলা হলে উনি বুঝতেন, মোসলমানের টিমটাই বাঙ্গালীর টিম। কলকাতার দলটি বাঙালিও নয়,মোসলমান-ও নয়, এক্কেরে আন্তর্জাতিক – স্রেফ টাকাটা দিল্লি-বম্বের। অন্যের মাতাকে মাতৃজ্ঞানে পুজো করতে বাধ্য হবার মত পরাধীন ওরা নয়, সেটা ‘মাইন্ড’ না করার মত শিরদাঁড়াহীন-ও ওরা নয়। ওরা বাংলার ভবিষ্যৎ বলতে জাতির, ভাষার ভবিষ্যৎ বোঝে – আমরা বুঝি রাজারহাটে কল-সেন্টার।  আমাদের মধ্যে ‘কানেকশান’ সত্যিই আজ কম।  কারণ ওরা বাঙ্গালী, আমরা বং।

1 Comment

Filed under বাংলা, Bengal, Delhi Durbar, Dhaka, Identity, India, Kolkata, Nation

মেরী কম, তেরঙ্গা বেশি

[ Ebela, 10 Oct 2014]

জাতীয়তাবাদের মার শেষ রাতে, এমনই আমার সাম্প্রতিক উপলব্ধি । নাইটশোতে হিন্দী বই ‘মেরী কম’ শেষ  হলো ‘জনগনমন’ দিয়ে। বইটার-ই অঙ্গ – হলমালিকের অত্যুত্সাহ নয়। প্রায়ে মাঝরাতে রাষ্ট্রপ্রেম পরীক্ষা। কে দাঁড়ায়ে, কে দাঁড়ায়ে না – এই সব পায়তারা। বন্ধুর থেকে খবর পেলাম হিন্দুস্তানের রাজধানীর। সেখানে একটি সিনেমা-হলে নাকি এই দাঁড়ানো-না দাঁড়ানো কেন্দ্র করে হাতাহাতি হয়েছে।  তা ভালো।  ঘুষোঘুষি নিয়ে যে বই, তার যবনিকা মুহুর্তে কিছু মানুষের হাত নিশপিশ করতেই পারে। সেখানেই ছবির সার্থকতা। মশলাদার ডিনার খেয়ে পেট গুরগুর, হল-এ ঠায়ে বসে কোমর অবশ কিন্তু বুকে চাগার দেয়ে ‘ইন্ডিয়া’। পয়সা উসুল।

চ্যাম্পিয়ন মনিপুরি মুষ্টিযোদ্ধা মেরী কম-এর জীবনসংগ্রাম-ই ‘মেরী কম’ বই-এর মূল ব্যাপার। তাতে নানা ভাবে এসেছে একাধিক প্রসঙ্গের ছোয়াচ – মনিপুরের রাজনৈতিক অস্থিরতা, মনিপুরীদের সঙ্গে হিন্দুস্তানিদের বৈষম্যমূলক ব্যবহার, ভারতীয় বাহিনী, মনিপুরি সন্ত্রাসবাদী ( কারুর কাছে সসস্ত্রসংগ্রামি), ইত্যাদি। ‘মেরী কম’ মালাইকারি-তে নাম চরিত্রের ব্যক্তিগত  সংগ্রাম-সংসার যদি হয় চিংড়ি, তবে এই অন্য গল্পগুলি হলো মশলা। চিংড়ি যতই ভালো হোক, মশলা ঠিকঠাক না পড়লে, ঠিক করে না কষলে, পাতে দেওয়া যায় না – বিশেষতঃ সে পাত যখন ছড়িয়ে আছে ভারত রাষ্ট্রের শহরে-গঞ্জে হলে-মাল্টিপ্লেক্সে। প্রতিদিন বলিউডের হেসেলে তৈরী খাবার হিন্দী-মাতা বেড়ে দ্যান দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা তার রাষ্ট্রপ্রেমী সন্তানদের পাতে । অশোক-স্তম্ভের উপর দাঁড়ানো সিংহ-গুলির গায়ে গত্তি লাগে। অনেকেই এখন নানা কুইজিন আস্বাদন করতে চান – একটু মুখ বদলানো, একটু ‘বৈচিত্রের মধ্যে একতা’ আর কি । তাই জমে গেছে ‘মেরী কম’ এর গল্প – এক মেয়ের কাহিনী, এক মায়ের কাহিনী, এক স্ত্রীর কাহিনী, মনেপ্রাণে ভারতীয় এক  মণিপুরীর ভারতের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার কাহিনী, প্রান্তিক ভারতীয়তার মঞ্চের কেন্দ্রে আসার কাহিনী, দুষ্টু মেয়ে মনিপুরের সাথে ভারতমাতার মান-অভিমানের কাহিনী। ভারত রাষ্ট্র লিবারেল – এসব এখন নেওয়া যায়।  মনিপুরি-দের কথা জানিনা তবে নাগা-রা নাকি আরো কিসব খায়। সেসব হিন্দুস্তানী পাতে দেওয়া মুশকিল কারণ কিছু স্বাদ এতই ভিন্ন যে অনেক তেরঙ্গা গরম মশলা দিয়েও তা বাগে আনা যায় না। যে সাপের বিষদাঁত আছে, তাকে নিয়ে খেলা দেখানো যে বিপদজনক তা সব সাপুড়ে জানে।

‘মেরী কম’ বইতে অন্তঃসত্ত্বা নায়িকা তার স্বামীর হাত ধরে এগোচ্ছে হাসপাতালের দিকে।  প্রসব বেদনা উঠেছে।  বাইরে চলছে কারফিউ। স্ত্রী-কে একটু অপেক্ষা করতে বলে স্বামী এগিয়ে গেল। রাষ্ট্রবিরোধীদের তাড়া করতে ব্যস্ত  খাঁকি উর্দি পড়া সরকারী বাহিনীর সামনে পরে গেল স্বামী। সে জানালো তার স্ত্রীর কথা।  এক জওয়ান এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেল স্ত্রী-কে – ঠিকই বলছে। যেতে দেওয়া হলো। অস্থির মণিপুরের এমন নানা কাল্পনিক খণ্ডচিত্র বারবার ফিরে আসে ‘মেরী কম’-এ। কাল্পনিক বলছি কারণ কিছু বাস্তব বড়ই অন্যরকম। সেই বাস্তবের মণিপুরে সরকারী বাহিনী ইম্ফল-এর ভিড়ের রাস্তায়  দিনে-দুপুরে সকলের সামনে চংখাম সঞ্জিতকে ঘিরে ফেলে। সঞ্জিত বাধা দেয় না। উর্দিধারীরা তাকে নিয়ে যায় রাস্তার পাশে এক ওষুধের দোকানের মধ্যে। কয়েক মিনিট  বাদে সঞ্জিতের রক্তাক্ত মৃতদেহ খাঁকি-ওয়ালারা বাইরে এনে তুলে দেয় একটা ট্রাক-এ। পুলিশ একই সঙ্গে আরেকজন যুবক-কে তাড়া করে এবং গুলি করে মারে পথচলতি রবীনা দেবীকে। রবীনা দেবীও ছিলেন অন্তঃস্বত্ত্বা। রবীনা দেবী ও সঞ্জিতের নিথর দেহদুটি ট্রাক-এ পরে থাকে পাশাপাশি।  প্রায় সিনেমার মতই এই ঘটনাটির সব মুহূর্ত  লাইভ ধারাভাষ্যের মত উঠে যায় কামেরায়ে। আগ্রহী পাঠক গুগুল দেবতার কাছে খোজ করলেই তা দেখতে পাবেন। মাল্টিপ্লেক্সে বর্ণিত অস্থির মণিপুরের যে শিশুভোলানো নকল চিত্র, তার পাল্টা এই অন্তঃসত্বার বিয়োগান্ত পরিণতি। বিশেষ সেনা ক্ষমতা আইন-এর তলায় কাঁপতে থাকা মণিপুরীর দৈনন্দিন বাঁচা ও মরার গল্পের বাজার নেই। নাকে-নল নিয়ে অনশনকারী ইরম সর্মিলার আখ্যান পপকর্নের স্বাদকে একটু তেঁতো করে দিতে পারে।আর সেন্সর-বোর্ড তো আছেই – প্রাপ্তবয়স্ক দেশবাসীকে এই অনুত্তেজক রাষ্ট্রীয় নগ্নতা থেকে বাঁচানোর জন্য। তাই খেলাধুলাই ভালো। মণিপুরী মেয়ের শত প্রতিকূলতায় ভারতীয়ত্ব প্রমানের চেষ্টা এবং আসতে আসতে ভারতমাতার পক্ষ থেকে তাকে বুকে টেনে নেওয়া।  তালি তালি। আর যারা ভারতীয় হতেই চায় না? ওদিকে যেও না ভাই ফটিংটিং-এর ভয়। তেরঙ্গা বুনয়িপ একেবারে কাঁচা খেয়ে ফেলবে – কেউ জানতেই নাও পারতে পারে।

তাই ফিরে আসি ফিলিমেই। বাঙালি বা পাঞ্জাবি অভিনেত্রী দিয়ে ‘অথেন্টিক’ সাঁওতাল বাহা বা দুলি নামানো গেছে ইষ্টিকুটুম থেকে অরণ্যের দিনরাত্রিতে। সঞ্জয় ভনশালী সেদিক থেকে অনন্য নন। তিনি ভালোই জানেন যে তার বই-এর বাজার ইন্ডিয়া নামক চড়া তেরঙ্গা এলাকায়ে, মনিপুর-মিজোরাম-নাগাল্যান্ডের মত ফিকে তেরঙ্গার দেশে নয়। বাস্তব জীবনে মণিপুরী নন ভারতীয়-বাহিনীতে কর্মরত পিতা-মাতার কন্যা প্রিয়াঙ্কা চোপরা। ‘মেরী কম’ সেজে তিনি যা আয় করেছেন, মেরী কম বক্সিং রিং-এ এতদিনে তা আয় করেননি, করতে পারবেন ও না। তবু দুচোখে স্বপ্ন থাকলে ক্ষতি কি? ঠিক যেমন ‘মেরী কম’ বইটি রিলিজ হবার দিনেই শিক্ষক দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রিজির ভাষণ শেষে ইম্ফল থেকে তাকে প্রশ্ন করলো ১৭ বছরের এক মিজো তরুণ। আমি কি করে প্রধানমন্ত্রী হতে পারি ? প্রধানমন্ত্রিজি ইয়ার্কিছলে উপদেশ দিলেন ২০২৪-এর নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে। যে সর্বজ্ঞাত সত্য তিনি বলেননি তা হলো অশোক-স্তম্ভের রাষ্ট্রে কোন মিজোর প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব না – আজ না, কাল না, ২০২৪ এও না। তারা বরং চীনা-জাপানী টিপ্পনী শুনতে শুনতে তথাকথিত ভারতীয়ত্বের তথাকথিত মূলস্রোতে গা ভাসানোর চেষ্টা করুক। এই চেনা ছকের বাইরে গেলে যে পরিণাম খুব একটা মনোরম হয় না, তা জানেন মনোরমা। বছর ৩৪-এর থাংজাম মনোরমাকে ২০০৪-এ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আধাসামরিক বাহিনী। অনেক বুলেটে বিদ্ধ এবং পুরুষসিংহদের বীর্যমাখা মৃতদেহ পাওয়া যায় পরদিন। এর প্রতিবাদে ৩০জন মণিপুরী নারী সরকারী বাহিনীর সদরদপ্তরের সামনে উলঙ্গ হয়ে গর্জে ওঠেন – আমরা মনোরমার মা, ভারতীয় বাহিনী আমাদেরও ধর্ষণ করো। যেদেশে মনোরমার ও তার মায়েদের গল্প হিন্দুস্তানী মশলা ছাড়াই নাইট-শো তে পরিবেশিত হবে, সেই দেশের জাতীয় সংগীতের আওয়াজে দাঁড়ানোর জন্য অপেক্ষায় রইলাম।

Leave a comment

Filed under Army / police, বাংলা, Culture, Hindustan, Nation, Terror

সংহতির রাজনীতি – গাজা থেকে আইসিস

[ Ebela, 4 Sep, 2014]

গণহত্যার ফলে যখন মানুষ মারা যায়ে, তখন ‘সন্তান মোর মার’ গোছের ভাবনার একটা দাম আছে। কিন্তু কত মানুষ মরলো, সেই সংখ্যার বিচার-ও একদম ফেলনা নয়।  তাই তো চোরাগোপ্তা হাজারো হত্যার মাঝেও জ্বলজ্বল করে কলকাতা ৪৬, নোয়াখালি ৪৬, পাঞ্জাব ৪৭, বরিশাল ৫০, দিল্লী ৮৪, গুজরাট ২০০২। গণহত্যা বা জেনোসাইড কথাটিও ঠিক যত্রতত্র ব্যবহারের জিনিস নয়।  পৃথিবীর বুকে থাকার অধিকার আছে সকলের। একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী নিকেষ হবার উপক্রম হলে শুধু কটা মানুষ হারিয়ে যায় না।  হারিয়ে যায়ে পৃথিবীকে ও জীবনকে দেখার একটি প্রণালী। হারিয়ে যায়ে মানুষ হবার নানা বিকল্প পথের একটা।  ফলে আমরা সকলে একটি মোক্ষম চেতনার একটা অংশ হারায়।  সেটা হলো – নানা ভাবে মানুষ হওয়া যায়ে।  এই যুগে যখন জামা-কাপড়-খাওয়া-দাওয়া-শিল্প-সংস্কৃতি-কথন-বলন সবই যখন বিশ্বজুড়ে একরকম হয়ে আসছে, এই চেতনাটি খুব দামি।  মানব জীবনের বৈচিত্র ওই ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’-র মত ছেলেভোলানো সরকারী স্লোগান না।  এটা মানব জাতির ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে বিস্তৃত করে।
এজিদী-রা সংখ্যায় খুব বেশি নয়।  ব্রিগেডে বড় মিছিলের দিন নেতা-নেত্রীরা কত লোক এসছে, তার যে করেন , তার মতই সংখ্যা হবে তাদের। ইরাকে তাদের মূল নিবাস।  এরা ক্রিষ্ঠান বা মসলমান নন – এদের ধর্ম অতি প্রাচীন। সম্প্রতি ইরাক ও সিরিয়া-তে ইসলামিক স্টেট নামক জল্লাদতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছে।  রক্তের হোলি খেলা এই    সন্ত্রাসী আন্দোলনের নাপসন্দ যে তাদের অধীকৃত এলাকায়ে বিধর্মী-রা বেঁচে-বর্তে থাকবেন।  তাই শুরু হয়েছে ঢালাও জবাই। এজিদী-দের, ক্রিস্টান-দের, এবং ইসলামিক স্টেট-এর সংজ্ঞায় যারা মোসলমান হয়েও ‘সহি’ মোসলমান নন, তাদের। তাদের হত্যা-লীলায়ে মৃতের সংখ্যা বেশ কয়েক হাজার।  এবং এজিদী-দের কে তারা যেমন করে  নিকেশ করছে, তা গনহত্যারই সামিল। কিন্তু এই গণহত্যার প্রতিবাদে অকাদেমি অফ ফাইন আর্টস-এর সামনে কোনো মোমবাতি, কোনো সহমর্মিতা, কোনো ধিক্কার, কোনো দরদ ফুটে ওঠে নি। লাল-তেরঙ্গা নানা দলের গাজায়ে ইস্রাইলি আগ্রাসনের বিরোধিতা করা  হুড়োহুড়ি দেখে মনে চিন্তা জন্মায়ে।  অন্য সকল ব্যাপারে এমন নিস্তব্ধতা কেন? কোনো কোনো মৃত শিশুর ছবি কি বেশি কান্নার উদ্রেক করে? যদি তাই হয়, তবে কি সেই বেশি দুঃক্ষ ও বেশি সহমর্মিতার মাপকাঠি ?
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আমি ছাত্র ছিলাম, তখন পালেস্তাইন সংহতি আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে আমাকে নানা ভাবে হেনস্থা করা হয়।  সে হেনস্থার কারণে  আমার সংহতি আন্দোলনে যুক্ত থাকার জন্য একটুও আমার একটুও খেদ নেই।  অনেকে এর চেয়ে অনেক, অনেক বেশি দাম চুকিয়েছেন।  কিন্তু পালেস্তাইন সংহতির নাম তার  বিশাল বপুতে কি কি লুকিয়ে থাকে, তার খোজ নেওয়া প্রয়োজন। যদি কোনো সংহতি আন্দোলন ব্যক্তিগত জাতি, ভাষা, ধর্ম  উদ্বুদ্ধ হয় কিন্তু তা প্রকাশ্যে মানবতাবাদের নাম চালানো হয়, তখন সেই ফাঁকিটা বোঝা দরকার।  ফেইসবুক বা  টুইটার-এর কল্যাণে আমার নিরীহ অনেক পালেস্তিনীয় শিশুর বীভত্স মৃতদেহের ছবি দেখেছি।  দেখেছি ইসরাইলী হানায়ে ছিন্ন-ভিন্ন সাধারণ মানুষের ছবি, অনেক ক্ষেত্রে একই পরিবারের একাধিক সদস্যের। কিন্তু কোথায় নাইজেরিয়া-র বোকো হারাম বা ইরাক-সিরিয়ার ইসলামিক স্টেট-এর ততোধিক নৃশংসতার ছবি? এই একচোখামী-র একটা মানে আছে।  এতে কিছু  ধরনের মৃত মানুষের প্রতি সহমর্মিতা আদায় হয়, কিছু হানাদারের প্রতি ঘৃণা উদ্রেক করানো হয় এবং কিছু ধরনের হানাদারের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকা হয়। এই চুপ থাকা অনেক কিছু বয়ান করে।
মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার হবার সময় এই বাছাবাছি, এই চিত্কার ও নিশ্চুপ থাকার আলো-আধারি খেলার তলার খেলাটা কী? তাহলে বলতেই হয়, এই মৃতের প্রতি সমমর্মিতার ব্যাপারটি ভুয়ো।  যা সত্য, তা হলো হানাদারকে আমি কতটা ঘৃণা করি সেটা প্রকাশ করতে আক্রান্ত ও মৃত-কে ব্যবহার করে।  সেই সংহতির রাজনীতি ন্যক্কারজনক।  হানাদারের  ধর্মীয়/জাতিগত/শ্রেণীগত পরিচয় দিয়ে যদি গণহত্যার জন্য কাঁদবো কি কাঁদবো না, পথে নামবো কি নামবো না, সেসব ঠিক হয়, তাহলে সমস্যা বড় ভয়ানক।  আক্রান্তের ধর্মপরিচয় , আততায়ীর ধর্মপরিচয় – এগুলি দেখে সহমর্মিতার ভঙ্গি, তা যতই সততার সঙ্গে করা হোক, অন্য ভেজালে তা ভুরভুর করে।  ছত্তিস্গরে যখন হিন্দু গ্রামবাসীরা মূলতঃ হিন্দু মিলিটারী দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন হিন্দুত্বের ঠিকাদার-দার মুখে যায়ে না কোনো প্রতিবাদ।  পাকিস্থান,আফ্ঘানিস্থান, সিরিয়া, ইরাক – এসকল জায়েগায়ে গত এক বছরে প্রায় এক লক্ষ্  মোসলমান মারা গেছেন মোসলমানের হাতে সন্ত্রাসী কায়্দায়ে।  তখন হয় না মিছিল।  হত্যালীলা যখন চালায় মূলতঃ ইহুদী ইসরাইল রাষ্ট্র-শক্তি, তখন মাথা চাড়া দেয় মানবাধিকার, সংহতি, ইত্যাদি। এই দুনম্বরিকে পষ্টাপষ্টি দুনম্বরী বলা প্রয়োজন।
গাজায়ে ঘটে যাওয়া হত্যালীলায়ে আমরা ব্যথিত।  আমরা সকলে জানি গাজার গল্প।  আমরা মন থেকেই এই আগ্রাসনকে ঘেন্না করি।  কিন্তু আমাদের এই ঘেন্না করার লিষ্টি-তে কার অগ্রাধিকার , সেটা কিন্তু ঠিক হয় অন্য কোথাও।  আমরা জাগি ঘুম থেকে, কিন্তু ঘড়ির অ্যালার্ম দেওয়া হয় অন্য কোথাও।  কিসের থেকে কি ‘বেশি’ গুরুত্বপূর্ণ, তা ঠিক করে দেয় যে বিশ্বকল্প, তা কি স্রেফ মানবতাবাদের ভিত্তিতে তৈরী? কোন মৃত্যু হয় হেডলাইন আর কোন মৃত্যু হয় সাইডলাইন? তাই ন্যুয়র্ক, লন্ডন, কলকাতা, প্যারিস – সকলে যখন জানায়ে ধিক্কার ও সমবেদনা, তলিয়ে ভাবা দরকার – কেন শুধু  এদেরকে ধিক্কার? কেন আরো বিস্তৃত নয় সমবেদনা ? পালেস্তাইন-এর মুক্তি চাই, মার্কিন সমর্থনে ইস্রাইলি আগ্রাসন মানছি না, ইত্যাদি বলা সহজ।  কঠিন হলো মানুষ হিসেবে গাজার পাশে দাড়ানোর অধিকার অর্জন করা।  ২০১৪-তেই যেসব বৃহত্তর গণহত্যার জন্য বাংলায়ে একটি মিছিল-ও হয় নি, সেই গণহত্যার শিকার যে মানুষ, তারা সেই অধিকার অর্জনের পরীক্ষা নেবে। আমরা তৈরী তো ?

1 Comment

Filed under বাংলা, Our underbellies, Power, Religion, Terror, Under the skin

খেলা স্রেফ খেলা নয়

[ Ebela, 15 Jul 2014]

পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল আমাদের চেতলা পাড়া থেকে রাসবিহারী মোড় যাওয়ার অটো রুটেই। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের রক্ত পতাকাগুলি নেমে আসতে শুরু করলো। তার জায়গায়ে এলো মা-মাটি-মানুষের নিশান। এখুন-ও সেগুলি উড্ডীন। এই পথেই এক-কালে বসত বিরাট রথের মেলা। চলত ১৪ দিন। এখুন সে ঐতিহ্যশালী মেলা চেতলা ব্রিজের নীচে নির্বাসিত। পরিসরে ১০ বছর আগের তুলনায় এক দশমাংশ-ও নয়। সে যাই হোক, বর্ষাস্নাত এক সন্ধ্যায় আমি রাসবিহারী মোড়ের অটোর জটলার দিকে গেলাম। দেখি কয়েকটা অটো-তে এক নতুন পতাকা। ব্রেজিল দেশের। এই পতাকা বদল সাময়িক এবং তার জন্য এই তরুণ অটোচালককে কোন চোখ রাঙ্গানি দেখতে হবে না।  কোনো সরকার, কোনো দল , কোনো ইউনিয়ন বা ক্লাব-কেই ব্রেজিলের থেকে কোনো ভয় নেই।  তাই একয়দিন নতুন পতাকা উড়বে। তা উরুক।  শত পতাকা বিকশিত হোক।

ব্রেজিল যে কজন মানুষকে গৃহহীন করে এই বিশ্বকাপ রোশনাই করছে, কত ব্রেজিলীয় সুরেশ কালমাদী রিও-সাওপাওলোর স্টেডিয়ামের ভিআইপি দর্শকাসনগুলি আলো করে আছে, তার বিবরণ আমাদের নরম হৃদয়ে ধাক্কা মারতে পারে, তাই ওই খারাপ জায়গায়ে বেশি হাতরাবো না। আর্জেন্টিনার ভক্তদের হাতে ব্রেজিলের বিরুদ্ধে খেলার মাঠের বাইরের রসদ দিয়ে লাভ নাই। এ যুদ্ধে যেই জয়ী হোক, নিখিল বাংলাদেশে একটি মানুষের কিসুই হবে না।  তবে তাতে কি? তা নয়, শুধু এটাই যে এই বাংলাদেশের বুকেই কলকাতার মাটিতে এক ফুটবল
যুদ্ধের ফলাফলে আমাদের কিসু এসে গেছিল। আইএফএ শিল্ডে কালা আদমির দল মোহনবাগান যখন সাহেবদের খেলায়ে সাহেবদের বাচ্চাদের হারিয়েছিল। এই খেলা শুধু খেলা নয়।  সমাজ-জাত কোন কিছুই শুধু খেলা থাকে না, সমষ্টিগত বোধ তাকে ক্রমে সামাজিক সত্যে পরিনত করে। বাংলাদেশের পাড়ায়ে পাড়ায়ে যে ফুটবল-চর্চা তা অনেকটাই কিআইএফএ শিল্ডের  যুদ্ধের উত্তরাধিকার নয় ? আর এই চর্চা যে খেলার জন্ম দেয়, তার দাম, তার শিহরণ, ঠিক হয়েছিল এই মাটির নিরিখে।  আমাদের সেরা দল ব্রেজিল বা আর্জেনটিনার কাছে ২০ গোল খেলেও নয়। সেটা আমাদের খেলা, আমাদের অতীত, আমাদের যাপন,  আমাদের রাজনীতির সঙ্গতে গড়ে ওঠা।  সেটা ফুটবল হলেও বিশ্বকাপ-এ যে খেলাটি হয়, সেটা নয়।
একান্তই আমাদের একটি খেলা। আমাদের ব্রাজিল, আমাদের আর্জেনটিনা একান্তই আমাদেরই।  কোন ব্রেজিলবাসী বা আর্জেনটিনাবাসী তাকে চেনে না।

ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মোহমডান, আবাহনী  – এই নামগুলি যে স্রেফ দল নয়, বরং ভিন্ন-ভিন্ন গোষ্ঠিচেতনার প্রকাশ, তার আভাস এখুনো খেলার মাঠে গিয়ে দর্শকাসনে কান পাতলে একটু একটু পাওয়া যায়। আজকে অতি ক্ষীণ হয়ে আসা এই গোষ্ঠিচেতনায় কুমোরটুলি, উয়ারী, রাজস্থান, এরিয়ান, টালিগঞ্জ অগ্রগামী স্রেফ ফুটবল দল মাত্র থাকে না , আমাদের সমাজজীবনের নানা খন্ডচিত্রের, শহর কলকাতার মধ্যে থাকা মানুষের আত্মচেতনার দলিল হয়ে থাকে। জাত-ধর্ম-জাতি-ভূগোল-ধন-অতীতের মত  আরো নানা পরিচয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গোষ্ঠী ও তাদের একান্ত ক্ষোভ-গর্ব-অভিমান ও এমন শত আবেগ-কে দিয়ে তৈরী বাংলাদেশের যে সমাজ চেতনা, ফুটবল তার এক প্রকাশ মাত্র। সমাজের
অভ্যন্তরের সংলাপ সেটি। তাই ব্রেজিল-কে লুঙ্গী পরে, আর্জেন্টিনা-কে সায়া পরে বাংলাদেশের সেই অন্দরমহলে ঢুকতে হত বহুকাল।  শত শত বার্সিলোনা-মেদ্রিদ-মিউনিখ-ম্যানচেস্টারের মিলেও অন্দরমহলের সে খেলা খেলতে পারবে না। স্পেনীয়দের নিজেদের দেশে কিন্তু বার্সিলোনা-মেদ্রিদ এমন-ই নিজস্ব আত্মচেতনার অংশ। কিছু খেলা, কিছু বোধ, কিছু মনোভাব, কিছু বিশ্বদর্শন একদম নিজেদের, একদম আসল জিনিস, একটুও বিনিময়যোগ্য নয়।  এই আসলটার একটা কার্টুন রূপ যে বিক্রয়যোগ্য, তা বিশ্ব-ব্যাপী খোলা বাজারের
ব্যাপারীরা বুঝে গেছে বেশ কিছুকাল । আজকের ব্রেজিল দল গড়ে ওঠে য়ুরোপের ভিন্ন ভিন্ন শহরের, জেলার, গঞ্জের আত্মচেতনার প্রকাশের নিশানী দলগুলির হয়ে ভাড়া খাটনেওয়ালাদের দিয়ে। ব্রেজিল ও বার্সিলোনা , দুই স্থানীয় মধ্যে যোগসূত্র বিশ্ব ফুটবল বাজারের কিছু পরিযায়ী পণ্য।

শ্বেতাঙ্গ থেকে শেখা খেলাকে আমরা নিজেদের করে নিয়েছিলাম – বিলেতের ফুটবল এসোসিয়েশন যে খেলার ঠিকাদার, তার সাথে আমাদের খেলার মিল বাহ্যিক। শ্বেতাঙ্গের তালে তালে ‘মানুষের মতো মানুষ’ হয়ে উঠতে আমরা আমাদের অন্দরের খেলাটির দিকে মৃত্যুবাণ ছুড়েছি। বিকিনি মডেল, চোলাই কোম্পানি আর মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল যখন তলে তলে এক দল হয়ে যায়ে , শেষের শুরু তখুনি। যে মৃত্যু গোষ্ঠ পালের বিষ্ঠাপুর্ণ মূর্তিতে মাল্যদান করে ঠেকানো যায়ে না। তাই অন্দরমহলে আনাগোনা লিভারপুল-ম্যানচেষ্টার-চেলসি দলের
নামধারী পণ্যগুলির। সদর দরজা এখন হাট করে খোলা। উঠোনের জাম গাছটির শিকড় আলগা হয়ে এসছে। এমনকি বট গাছটিও কেটে ফেলা হয়েছে – ৬ কাঠা জমিতে উঠেছে
যে বহুতল, তাকেই জায়গা করে দিতে। মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন নবসমাজের বিচ্ছিন্নতা একে অপরের সঙ্গে।  সামূহিক আত্মপরিচয় নাকি ব্যক্তিকেন্দ্রিক আধুনিকতার পথে বিশাল কাঁটা, এবং বেশ ‘ব্যাকডেটেড’ ও বটে।  তাই নবসমাজের আভ্যন্তরীন সংলাপ নাই, সমাজ থেকে উঠে আসা খেলার দরকার নাই, আমদানি করা মাল প্যাকেট শুদ্ধ গিলে ফেলার মধ্যেই মুক্তি।  ব্যাক্তিমুক্তি।

সমাজ থেকে উঠে আসা বলেই বিভিন্ন স্তরে যে ফুটবল খেলা হয় নিখিল বাংলাদেশে। অন্ত্যজের ক্ষমতায়নের সাথে তাল মিলিয়েই উচু-জাতের মৌরসীপাট্টা নয় আর ফুটবল। তাই দেশীয় এলিটের দেশীয় ফুটবল এমনিতেও দৃষ্টিকটু লাগবে। যে কারণে দৃষ্টিকটু লাগে না টলিউড বা বলিউডের প্রধান অভিনেতা-অভিনেত্রী-কলাকুশলী -নির্দেশক-প্রযোজকদের মধ্যে উচু জাতের, রয়িস খান্দানের মানুষের প্রায় একাধিপত্য।  সংবেদনশীল ফিলিমপ্রেমীরা তা দেখতে যান, প্রশংসা করেন, খারাপ বলেন। হলিউডিও-য়ুরোপীয় তুলনা দ্যান। এও এক
ধরনের সমাজের আভ্যন্তরীন সংলাপ।  তবে সে সমাজের পা কি মাটিতে ? সে সমাজের স্বপ্ন কি নিজের না আমদানি করা? সেই সমাজের লিভারপুল প্রেমের মধ্যে নিজের
পারিপার্শিক সমাজকে ঘেন্নার একটু গন্ধ কি নেই ?

কোনো কিছুই বিনামূল্যে হয় না।  কোনো না কোনো ভাবে মূল্য চোকাতে হয়। যখন চেতলায়ে কেউ হয়ে ওঠেন চেলসির ভক্ত, মল্লিকবাজারের কোনো বহুতলীয় তরুণের স্বপ্নে দেখা দেয় ম্যানচেষ্টার, তখন আমাদের আত্মপরিচয়ের ভিত আলগা হয়। অতীত ও সমাজ, দুই হতেই বিচ্ছিন্ন বাঙ্গালীকে তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গণমৃত্যুর কথা জিজ্ঞেস করলে শুনতে পাবো ইহুদী, জিপসী ও অন্যান্য শ্বেতাঙ্গ গোষ্ঠির নাম। ১৯৪৩-এ  ব্রিটিশ শাসক ও তার দেশীয় তাবেদারদের ষড়যন্ত্রে যে ৩০ লক্ষাধিক মানুষ মারা গেছিল নিখিল বাংলাদেশে, মৃত শ্বেতাঙ্গদের সাথে তারা একাসনে জায়গা পায়না।  কল্পনা ও আত্মপরিচয় যখন সমাজ-বিচ্ছিন্ন, তখন সে নরসংহারের চিত্র উত্তরপুরুষদের জন্য রেখে গিয়েছেন যে  জয়নুল আবেদীন বা চিত্তপ্রসাদ, তাদের নাম যে চেলসির ভক্ত জানে না, তা কি খুব আশ্চর্যের? উত্তর-মনমোহন কলকাতা তথা বাংলায়ে সমানে চলেছে জাম গাছের শিকড় উপড়ে কিউই ফ্রুট খেতে শেখার গল্প। বিশ্বায়িত হওয়া মানে শ্বেতাঙ্গ মানুষের আত্মপরিচয়ের সাথে হাইফেন দ্বারা যুক্ত হওয়া। এটলেটিকো মাদ্রিদ ‘কলকাতা’কে নিলামে কিনে বানায়ে ‘এটলেটিকো ডি
কলকাতা’।  কালা মানুষে ধন্য হয়।

Leave a comment

Filed under বাংলা, Bengal, Colony, Dhaka, Elite, Kolkata