কদিন আগে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের উপর সরকার মদতপুষ্ট ‘শিক্ষাকর্মী’ ভেকধারী কিছু গুন্ডা বর্বর আঘাত নামিয়ে আনলো। শুনছি এস.এফ.আই এবং ডি .ওয়াই.এফ.আই-এর টগবগে তরুণ-রা নাকি এতে ভীষণ ক্ষুব্ধ। এই উঠতি চে গুয়েভারারা ধুতি-পাঞ্জাবী পরে কয়েক দশক ধরে হোলটাইম স্তালিনবাদ করা পার্টি শিরোমনীদের জিজ্ঞেস করে দেখলে পারেন যে এই মারকুটে ‘শিক্ষাকর্মী’দের মধ্যে কারা কারা ৫ বছর আগেও কর্ডিনেশন কমিটির সদস্য ছিল এবং নিয়মিত কিনতো ‘সংগ্রামী হাতিয়ার’? অতীতের শুরু ১৯১৭-তে না, ২০১১-তে তো নয়ই। তা সে যাই হোক, বর্ধমানের ঘটনার প্রতিবাদ করতে পশ্চিমবঙ্গের
‘স্বশাসিত’ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ‘স্বাধীন’ উপাচার্য্যরা যে লাইন দিয়ে নিন্দামূলক বিবৃতি দেবেন না, সেটা বলাই বাহুল্য। ঘটনাটা সত্য কি অসত্য, কুকুর মানুষকে কামড়েছে না মানুষ কুকুরকে কামড়েছে, এই বিতর্কে তেরঙ্গা ঝান্ডাধারী ‘শিক্ষাকর্মী’দের দ্বারা ছাত্রীদের প্রহার ও শ্লীলতাহানি শীঘ্রই চাপা পড়ে যাবে। বর্ধমানের সত্য জানতে কোন ‘রাষ্ট্রীয়’ চ্যানেলের ওবি ভ্যান ছুটে যাবে না সেদিকে। ‘সত্যমেব জয়তে’ হলো ভারতীয় রাষ্ট্রের স্লোগান – অর্থাৎ শুধু সত্যেরই জয় হবে। যেটা উহ্য, তা হলো এই ‘সত্য’ পয়দা করার মেশিনগুলির মালিকানা যাদের হাতে, জয় হবে তাদেরই।
কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। এই যে বর্ধমানের ঘটনা, বা সবং সজনীকান্ত মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র কৃষ্ণপ্রসাদ জানার খুন হবার ঘটনা, এগুলি নিয়ে কোন ‘কলরব’ হয় না কেন? এর কারণ কি ? বড় শহর থেকে দূরের ঘটনা বলে? ইংরেজিতে জ্বালাময়ী ও ক্ষুরধার বক্তব্য ফেইসবুকে তারা দেয়নি বলে ? এখান থেকে পাশ করে তারা দিল্লি-মুম্বই-বিলেতের নানা জায়গায় প্রাক্তনী-চক্র তৈরী করতে পারেনি বলে? আমাদের এই সংহতির জাতপাত, পাশে দাঁড়ানোর বাছ-বিচারের সাংস্কৃতিক রাজনীতিকে বুঝতে হবে। নইলে আমাদের বর্ধমানে শ্লীলতাহানিগুলি, সবং-এ খুন গুলি চিরকাল থেকে যাবে ব্রাত্য, ঠিক যেমন মোমবাতি সংহতি থেকে ব্রাত্য থেকে যায় দলিত মেয়ের উপর গণধর্ষণ। আর এফ.টি.আই.আই-গজেন্দ্র বা ‘নির্ভয়া’ ঘটনার ‘সচেতন’ সংহতির কলরবে হারিয়ে যায় ‘বাকিরা’,
সংখ্যাগরিষ্টরা – ইংরেজির ক্রাচ ব্যবহার করে ‘গভীর’ মনোভাব প্রকাশে যারা এখুনো সাবলীল হয়ে ওঠে নি – তারা।
মনে পরে যাদবপুরের কলরব? সে ঘটনার সংহতিতে দিল্লীর জহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ে, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে, পুণের ফিল্ম ইনস্টিটিউটে এবং গরিব দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দ স্বল্প তেলের বেশিরভাগ অংশ যেসব টাকে লাগানো হয়, সেইরকম সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংগঠিত হয় সংহতি আন্দোলন। যাদবপুরের পাশে থাকা। পুণের ফিল্ম ইনস্টিটিউট-এ সরকার সত্যবাদী গজেন্দ্রকে বসিয়ে জায়গাটাকে একটু আয়ত্তে আনতে চাইছে, আবার সংগ্রামের দিনে পাশে থাকা মানুষগুলিকে কিছু উচ্চপদে বসিয়ে কৃতজ্ঞতাও জানাচ্ছে – যেমনটা জনগনের সম্পত্তিকে বাপের মাল তথা লুঠের মাল মনে করা দলগুলি মনে করে থাকে চিরকাল। তার প্রতিবাদ করেছে ফিল্ম ইনস্টিটিউট-এর শিক্ষার্থীরা। তাদের যারা পাশে দাঁড়িয়েছে, তাদের মধ্যে বলিউডের প্রধান তারকাদের মধ্যে খুব কম মানুষই আছেন। এই মর্মে হলিউডের সাথে তুলনাটা জরুরি, যেখানে নানা সাধারণ রাজনৈতিক প্রশ্নে ফিলিম জগতে গুরুত্বপূর্ণ অনেকেই রুপোলি পর্দার আড়ালে নিজেদের ঢেকে রাখেন না। চার্লি চ্যাপলিন থেকে সুসান সারান্ডন – নিজ রাষ্ট্রের দ্বারা সংগঠিত অত্যাচারের প্রতিবাদের মাধ্যমে এরা দেখিয়েছেন যে চলচ্চিত্র একটি মাধ্যম মাত্র এবং চলচ্চিত্র-জগতের সাথে জড়িত বলেই সেটাই তাদের একমাত্র মাধ্যম নয় – অন্য সকলের মতই, তাদের মুখ আছে, হাত আছে, পা আছে। হিন্দী ফিল্ম সংস্কৃতির টপ লোকেরা অবশ্য কংগ্রেসী টুপি পরে ১৯৮৪-র শিখবিরোধী দাঙ্গায় প্ররোচনা দিতে অথবা মদ্যপ অবস্থায় ফুটপাথবাসীদের গাড়ির তলায় পিষে দিয়ে খুন করতেই বেশি ভালবাসেন (গুজরাট পর্যটন সংস্থার দালালি করে বা অনাথাশ্রমে ছিটে ফোঁটা দান করে সেসব পাপ ঘোঁচে না), তাই এই ধরনের জীবগুলির থেকে কোন ধরনের সংহতি আশা করা শক্ত। তবে পুণের পাশে আছে এলিট নানা বিশ্ববিদ্যালের ছাত্র-ছাত্রীরা, কলরবিরা, মতলবিরা এবং আরো অনেকে। জহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু হলে সংহতি জানায় প্রেসিডেন্সি, সেখানে কিছু হলে পাশে দাঁড়ায় যাদবপুর। এরা অনেকেই একে অপরকে চেনে, পৌছে যায় একে অপরের কাছে, একে অপরের হোস্টেল-এ ওঠে, পাশে থাকে, সাথে থাকে, এলিট প্রতিষ্ঠান-জাত বুঝে নিয়ে এক থালায় খাবার খায়। খবর ছড়ায় প্রাক্তনিদের মধ্যে, সংবাদ-মাধ্যমের ‘সিনিয়র’দের মধ্যে। এইটে হলো একরকম সাংস্কৃতিক পুঁজি – যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে উচ্চ-কুল-শীলের আল্পনা আঁকা। কিন্তু তারপর সংহতির বৃত্ত বাড়ে না – খুজতে থাকে সেই চেনা এলিট-দের, চেনা ভাষ্য, চেনা ভাঁজ, চেনা স্লোগান, চেনা অবিন্যস্ততা – অসাধারণ ও ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনে তাই ‘সাধারণ’দের কোন জায়গা নেই। যাদবপুরের পাশে মফস্স্বল থেকে অনেকে এসে দাঁড়াতে পারে বৃষ্টির দিনে – যেন সেটা তাদের দায়িত্ব, কিন্তু বর্ধমানের পাশে গিয়ে যাদবপুরের দাঁড়ায় না – দূরত্বটা এক, তবে সংহতির গতিপথটা একমুখী।
যখন নানা বিষয়ে রাষ্ট্রের, সরকারের, সরকারী দলের নিপীড়ন ও নগ্ন স্বেচ্ছাচারিতায় গণমানুষ আক্রান্ত হয়, তখন এলিট সংহতির বৃত্ত তৈরী করে ক্ষুদ্র বৃত্তে বাহবা ও অন্যান্য জিনিস পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু তার থেকে দীর্ঘমেয়াদী বা দায়িত্বশীল কিছু আশা করা অনুচিত। তারা ক্যাম্পাসে ‘ফ্রীডম’ চান, সেই ‘ফ্রীডম স্ট্রাগেল’-এ জনমতকে আবার পাশেও চান, আবার সবং-এর মতো ‘আনকুল’ নামের জায়গার ‘সাধারণ’ কলেজের নৃশংসতার পাঁকে ঢুকতে চাননা, পরমহংসের মত গা না ভিজিয়ে ডুব দিতে চান গভীর জলে। সত্যই তো তাদের স্পেশ্যাল কোন দায় নেই, কিন্তু স্পেশাল দায় আছে বৃহত্তর সমাজের, তাদের কষ্টকে বোঝার। ‘আমাকে আমার মত থাকতে দাও’ এই সময়ের শিক্ষার্থী এলিটের জাতীয় সঙ্গীত। মরুঝড়ের মাঝে এলিট মরুদ্যানের নেটওয়ার্ক বানিয়ে কোন প্রলয় কখুনো বন্ধ হয়েছে আজ অবধি? একটা পুরনো সময়ের কিছু লাইন মনে এলো – ‘আমরাও তবে এই ভাবে, এ মুহুর্তে মরে যাবো নাকি, আমাদের পথ নেই আর, আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি..পৃথিবী হয়তো গেছে মরে, আমাদের কথা কে বা জানে, আমরা ফিরেছি দোরে দোরে, কিছুই কোথাও যদি নেই, তবু তো কজন আছি বাকি, আয় আরো হাতে হাত রেখে, আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।” বাংলার এলিট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে চাহ্ত্র-ছাত্রীদের আর্থ-সামাজিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়াও মিল রয়েছে সেখানে অবশিষ্ট অবাধ গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চায়। এর একটা বড় কারণ হলো যে এলিট নেটওয়ার্ক-এ থাকলে কলেজ পরবর্তী সময়ে শাসকদলের ল্যাজ না ধরেও ঠিকঠাক কেরিয়ার বানানো সম্ভব। এই তুলনামূলক নিরাপত্তার ফলে যে সাহসটুকু আসে, তাতে হিস্যার দাবি কি করতে পারে না
‘সাধারণ’রা? দিল্লী-পুণের হ্যেপ ও কুল বৃত্তের বাইরে অন্য জাতের হাত ধরতে এতো কুন্ঠা কিসের? এই প্রবন্ধটি কলরব বিরোধী নয়। এলিট না হয়েও স্রেফ
রবাহুত হয়ে যারা কলরবের পাশে দাঁড়ায়, তাদের জন্য কলরব হয় না কেন, মূলতঃ প্রশ্ন সেটাই।