আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে

“তুমি কে, আমি কে, বাঙালি, বাঙালি!” ( মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব্ববর্তী সময়ে গড়ে ওঠা প্রবাদপ্রতিম স্লোগান)

কয় বছর আগে ঢাকার কবি-প্রাবন্ধিক ফারুক ওয়াসিফ কটা কথা বলেছিলো, যা আজকে সৈয়দ সামসুল হককে নিয়ে লিখতে গিয়ে প্রথমেই মনে পড়ছে। ফারুক লিখছে, “এদেশি যারা ইংরেজি লেখা পড়েন, তারা কি বাংলা পড়েন না? অনেকেই পড়েন। উচ্চশ্রেণীর এবাদুর রহমানও বাংলাতেই লিখে থাকেন উচ্চশ্রেণীর জীবন নিয়েই; কিন্তু তাৎপর্যে তা দেশোন্মচনই করে তো! সুতরাং এর মধ্যে শ্রেণীঢং থাকলেও নিছক শ্রেণীর ডাঁট না পুরোটা। এটা হলো কালচার। এই কালচারালাজিম মনে করে, যা কিছু ন্যাটিভ তা নিম্নমানের। ন্যাটিভদের ভাষা ভঙ্গি উপমা ভাব ও কল্পনা এদের টানে না। না টানুক, কিন্তু তাদের নিজেদের মধ্যে টানটা কীসের? লাইফস্টাইলের প্যাটার্ন ছাড়া সেখানেও তো তেমন ঐক্য দেখি না। সুতরাং একে বাংলা বনাম ইংরেজির বিবাদ না ভেবে দেশি ও বিদেশি লাইফস্টাইলের মন কষাকষি ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না। এই ‘দেশ’ প্রবাসী লেখকের মনের মধ্যে চিরকাল অটুট থাকতে পারে, আবার ভৌগোলিকভাবে দেশে বাস করা লেখকের মনের মধ্যেও থাকতে পারে প্রবাসের প্রতি বিরহবেদনা। দেশেও কেউ বিদেশি, বিদেশেও কেউ দেশি থেকে যেতে পারেন যদি, তাহলে পার্থক্যটা অভিপ্রায়ের, সংস্কৃতির, চেতনার, কল্পনার, দায়বোধের এবং দিনের শেষে রাজনীতির।”

ফারুকের শেষের কথাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যে পার্থ্যকতা দিনের শেষে রাজনীতির। আজকে পশ্চিম বাংলার প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে, যখন হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের আগ্রাসনে লুঠ হয়ে যাচ্ছে ইতিহাস, আত্মপরিচিতি, স্বপ্ন, চেতনা আর এই ব-দ্বীপের হাজার বছরের অর্জনে পবিত্র যা কিছু আছে, এই জোর করে ভুলিয়ে দেওয়া সময়তেই আমাদের দরকার সৈয়দ সামসুল হককে, যার শব্দকে, তার শব্দ যে স্বচেতনা থেকে স্ফূরিত হয়, দরকার সেই স্বচেতনা, কারণ স্বচেতনা দরকার এই বিশ্বে নিজেদের খুঁজে পাওয়ার জন্য, দরকার ভুলিয়ে দেবার মাঝে নিজেদের খুঁজে পাবার জন্য, দরকার বানোয়াট কল্পনার মাঝে বাস্তবের নিরিখে নিজেদের গতকালের চেতনায় নিজেদের আজ-কাল-পরশু ঠিক করা, আজ-কাল-পরশুর রাজনীতি ঠিক করা। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে নিজেদের খুঁজে পাওয়া জরুরি। বিশ্ব নিখিলে আমাদের আকাশের তলায় একটা স্থান আছে, নিজেদের মাটির উপরে। দূরের খুঁটিকে সেলাম না করে নিজের মাটিতে খুঁটি পুঁতে তার নিরিখে উত্তর-দক্ষিণ নির্ণয় করা, বিশ্বকে চেনা এবং ফলতঃ নিজেদের চেনা।

এই বিশ্ব মানে উপর থেকে দেখা পৃথিবী নয়, বরং নিজেদের স্থানাঙ্ক থেকে যা দেখা যায়, যা বোঝা যায়, এই দেখা ও বোঝার আলোকে নিজেদের বুঝে নেওয়া। কেন্দ্রে রয়েছে আমাদের মাটি। সে প্রসঙ্গে ফারুক আবার বলেছে, “সালমান রুশদীর পুঁজিপাট্টা সবই উপমহাদেশীয়। পামুক কি মোরাকামি এত বিক্রি হয়; কারণ তাদের দেশজতা। অরূন্ধতি রায় কেরালার জীবন নিয়েই নাম কাড়েন। কেননা, বিশ্ব উপন্যাসের মহাফেজখানায় সেটুকুই তো অনাস্বাদিত! দেশবোধকে তাই বোধহয় অস্বীকার করা যায় না। জিয়া হায়দার রহমানের উপন্যাস পড়ছি, তাঁকে দেশহীন মনে হচ্ছে না, যদিও পটভূমি অন্য মহাদেশ। আপনি যদি কোনো সংস্কৃতি ও জীবনকে না বোঝেন, তাহলে আপনি কোথাকার কেউই হতে পারবেন না। লোকাল না হলে গ্লোবালের মজা বুঝবেন না। ব্যক্তির চেতনায় দেশের কল্পনা, দেহ–ভূগোলের স্পর্শ, ইতিহাসের বনলতার চোখে তাকানো ছাড়া বড় কাজ হয় বলে বিশ্বাস করি না। উদাহরণ নাই।”

আমি কবি নই, কবিতার খুব পাঠকও নই, কিন্তু এই বাংলায় বাংলা ও বাঙালির রাজনীতি ও নিজেকে বুঝে নেওয়ার যে আলোক বর্তিকাগুলি, তার মধ্যে আমি অবশ্যই ধারণ করি সৈয়দ শামসুল হককে।

“আমি জন্মেছি বাংলায়
আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে ?
আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।
এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে
এসেছি বাঙালি জোড়বাংলার মন্দির বেদি থেকে।
এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে
এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।
আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে”

সৈয়দ শামসুল হকের শব্দগুলি আমাদের সুযোগ করে দেয় ভাবতে – আমরা মানে কারা, কেন আমার রাষ্ট্র আমার করের টাকায় অন্যের ভাষা প্রচার করে কিনতু আমারটা করেনা। আমাদের ভেবে দেখতে হবে যে আমাদের নিজের নিপীড়িত মাতা থাকতে বিমাতাকে পূজা করতেশেখায় যে রাষ্ট্র, সে রাষ্ট্র কার আর সে রাষ্ট্র কার নয়। আমরা পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালী – বাংলার দেশের (বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নয়) ভাঙ্গা পশ্চিম ভাগ। এই ভাষা আমাদেরও প্রাণের ভাষা, বেঁচে থাকার অবলম্বন, ভালবাসার মাধ্যম, পূর্বসুরীর স্মৃতি, উত্তরসুরীর উত্তরাধিকার, ব্রতের ভাষা- ধর্মের ভাষা-রাজনীতির ভাষা- ঘাম ঝড়ানো কর্মের ভাষা – প্রেমের ভাষা- ফোপানোর ভাষা – খোঁটার ভাষা – অপরাধের ভাষা- দাঙ্গার ভাষা- যৌনতার ভাষা -না বলা কথার ভাষা – ভুলে যাওয়া দিনের ভাষা – আগামীকালের ভাষা- শপথের ভাষা -মুক্তির ভাষা। আমরা বাঙ্গালী।

এই পশ্চিম বাংলার আমরা, আমরা তো বানের জলে ভেসে আসিনি। আমাদের একটা অতীত আছে। সৈয়দ শামসুল হক দেন সে অতিচেতনা, দীর্ঘ, বহুত্ববাদী সে অতিচেতনা, বাঙালি সে অতীত চেতনা। এবং আজ যখন আমরা এই বাংলার স্বাধিকার তথা সম্মানের এক কঠিন লড়াই-এর দিকে অগ্রসর হচ্ছি, তখন পাথেয় থাকুন সৈয়দ শামসুল হক। কারণ উনি আমার জাতির। উনি ওনার কবিতায় আমার কথা বলেছেন। আমি ওনার লাইনে আমার কথা শুনেছি। কান পেতে শুনেছি, সে লাইনের মধ্যে রাজনৈতিক নির্দেশ। মননজগতে আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতীক কবি সৈয়দ শামসুল হক চলে গেলেন। উনি অক্ষয় স্বর্গ লাভ করুন। আমাদের জন্য রেখে গেলেন অনেক নির্মাণের গুরুদায়িত্ব। অনেক পথ চলা বাকি। অনেক প্রাচীর ভাঙা বাকি। অনেক প্রাচীর গড়া বাকি। আমরা চেষ্টা করবো কবি।

1 Comment

Filed under বাংলা, Bengal, Memory, Uncategorized

One response to “আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে

  1. All cats love fish & all thieves are cousins in Indian politics!

Leave a comment